প্রত্যেক মুসলমান পুরুষের জন্য টুপি পরিধান মহানবী (সা.) এর আদর্শ বা সুন্নত হিসেবে গণ্য; তবে ফিকহি বা শরিয়া আইনের বিবেচনায় তা মুস্তাহাব। তাই টুপি পরিধান করা নামাজ-জামাতের বেলায় যেমন বিধিবদ্ধ, একইভাবে অন্য সময়েও তা অনুসরনীয়। এ কারণে টুপিবিহীন সালাত আদায় সাধারণত ‘মাকরুহ’ হিসেবে গণ্য হবে। ‘মাকরুহ’ মানে ‘অপছন্দনীয়’ বা অনুত্তম। এর অর্থ ‘হারাম’ বা ‘নাজায়েজ’ ধরনের কিছু নয়।
টুপি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও শরিয়তে কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি, রং-সাইজ, গোল বা লম্বা- তেমন কিছু নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। সাধারণ যুক্তি মোতাবেক টুপি যেন মাথার সঙ্গে লেগে থাকে; মাথা হেলনের কারণে বা বাতাসে যেন তা পড়ে না যায় বা উড়ে না যায়- তেমন হওয়া উচিত। টুপি সাদা হবে, না কালো? দেখতে লম্বা হবে, না কি গোল- এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা বা তেমন কিছু প্রমাণে ঔদ্ধত্যপ্রদর্শন মারাত্মক অন্যায় বলে বিবেচিত হবে। কেননা, প্রাচীন ও আধুনিক যুগের আলেমণ্ডওলামা, ওলি-আউলিয়া, পীর-মুর্শিদদের মধ্যে লম্বা টুপির যেমন তা’আমুল বা রেওয়াজ ছিল ও আছে; তেমনি গোল টুপি ব্যবহারের রেওয়াজও ছিল এবং আছে। অনুরূপভাবে সাদা-কালো, রঙিন, কারুকার্যকৃত ও কারুকার্যবিহীন সব রকমের টুপি ব্যবহারেরও আমল ছিল এবং এখনও আছে। সাইজ মতো হলে গোল টুপি যেমন মাথার সঙ্গে লেগে থাকে, লম্বা টুপিও মাথার সঙ্গে লেগে থাকে। এটিই আসল বিবেচ্য।
বিশেষ কোনো প্রতিষ্ঠানের বা বিশেষ কোনো দল-মতের আলেমদের বা দরবার শরিফের বা পীর-মুরিদান ও ভক্তদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সাইজ বা রং-কায়দার টুপি নির্দিষ্ট করে দেওয়া বা করে নেওয়া; কিংবা বাধ্যতামূলক করতে যাওয়া মোটেও সমীচীন নয়। কেননা শরিয়ত তা নির্দিষ্ট করে দেয়নি। শরিয়ত যেখানে যা ব্যাপক রেখেছে, তা নির্দিষ্ট করতে যাওয়া অথবা যা উন্মুক্ত রেখেছে, তা বন্ধ বা সংকুচিত করতে যাওয়া; কিংবা যা সহজ রেখেছে, তা কঠিন করতে যাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়।
পাগড়ির ক্ষেত্রে যেহেতু সব হাদিসে বা অধিকসংখ্যক হাদিসে কালো রঙের কথা ও বর্ণনা স্পষ্ট; তাই পাগড়ির ক্ষেত্রে কেউ কালো রঙের পাগড়ি পরিধানকে ‘মুস্তাহাব’ বা উত্তম বলতে চাইলে, সেটিকে বাড়াবাড়ি বলা যাবে না; কারণ, তা মানসুস আলাইহি বা খোদ হাদিসের ভাষ্যে বিদ্যমান। পক্ষান্তরে সাদা-লাল-সবুজ ইত্যাদি রঙের পাগড়িকে উত্তম বলতে গেলে, সেটাই বরং বাড়াবাড়ি বলে গণ্য হবে। কারণ, পাগড়ির ক্ষেত্রে এসব রঙের কথা মূল দলিলে অবর্তমান বা মানসুস আলাইহি নয়।
কিন্তু টুপির ক্ষেত্রে যেহেতু তেমন বিশেষ ভাষ্য বা নির্দেশনা অবর্তমান; তাই টুপির বেলায় অমুক টুপি বা অমুক রং-সাইজের টুপি যেমন গোল টুপি বা নৌকা মার্কা টুপি বা পাঁচকল্লি টুপি ব্যবহার উত্তম দাবি করা যাবে না।
নিজেদের প্রতিষ্ঠানের বা স্কুল-মাদ্রাসার জন্য বিশেষ কোনো রং-আকার বা সাইজের টুপি নির্দিষ্ট করতে যাওয়া এবং তেমনটির প্রয়োজনে ছাত্র-শিক্ষার্থীদের, অভিভাবকদের বাধ্য করতে যাওয়া; কিংবা তা মেনে না চলায় শিক্ষার্থীদের মারধর-প্রহার বা জরিমানা করতে যাওয়া মোটেও বিধিসম্মত নয়। কেননা, বিষয়টি অর্থাৎ টুপি পরিধান কেবল কোনো জাগতিক ও মুবাহ-এখতিয়ারি ব্যাপারই নয়; তা বরং শরিয়তের বা ধর্মের পালনযোগ্য একটি ইবাদতও বটে; এমনকি তা অন্যতম শা’আয়ের বা প্রতীকও বটে। বিভিন্ন বাহিনীর ইউনিফর্মের বেলায় যেমনটি হয়ে থাকে ব্যাপার তেমন নয়। যদিও তা আইনগত বিবেচনায় মুস্তাহাব। অনুরূপ পাগড়ি পরিধানও একদিকে মুস্তাহাব পর্যায়ের সুন্নত, অন্যদিকে শা’আয়েরও বটে।
টুপি যেহেতু শরিয়তের নির্দেশ এবং ইবাদত হিসেবে গণ্য, সেহেতু তার বেলায় শরিয়তের প্রদত্ত নির্দেশনা, সহজতা, প্রদত্ত ব্যাপক অনুমতি-এখতিয়ার লঙ্ঘিত হয়- এমন কিছু করা ঠিক হবে না। তেমন কিছু করতে গেলে তার অর্থ দাঁড়াবে শরিয়ত টুপি ব্যবহারের যে ব্যাপারটিকে সহজ ও এখতিয়ারি রেখেছে; আমি তা কঠিন ও বাধ্যতামূলক করে দিচ্ছি! শরিয়ত তা (আম) ব্যাপক রেখেছে; অথচ আমি তা (খাস) নির্দিষ্ট করে দিলাম! শরিয়ত বলেছে, নফল-মুস্তাহাব কাজে বাড়াবাড়ি না করতে এবং ছাড়-সুযোগ দিতে; অথচ আমি তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি, এমনকি মারধর করছি, প্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্রকে বহিষ্কার পর্যন্ত করে দিচ্ছি! নাউজুবিল্লাহ!
এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ‘মুফতি সাহেব! আপনার ব্যাখ্যা মতেই যেহেতু যে কোনো রকম টুপি ব্যবহার করা যেতে পারে, তাই আমরাও আমাদের প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম হিসেবে বা ড্রেস-কোড হিসেবে পাঁচকল্লি বা কল্লি ছাড়া গোল বা লম্বা টুপি নির্দিষ্ট করে নিলাম, যাতে বুঝতে ও পরিচয় করতে সুবিধা হয় যে, এসব ছাত্র-ছাত্রী অমুক মাদ্রাসায় বা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। তাতে সমস্যা কোথায়?
তার জবাব হলো, তাতেও সমস্যা আছে। কেননা, আপনারা আলেমরা যারা উচ্চতর ফিকহ-ফাতাওয়ার ইলম অর্জন করেছেন; তারা অবশ্যই জানেন যে,
‘শরিয়ত যেখানে যা নির্দিষ্ট করেনি, সেখানে তেমন কিছু নির্দিষ্ট না করা’ এবং ‘শরিয়ত যা জরুরি সাব্যস্ত করেনি, তা জরুরি হিসেবে সাব্যস্ত করা’ মোটেও ঠিক নয়। বিশেষত ‘ইবাদত’-এর বেলায়। আমরা উল্লেখ করেছি যে, টুপি পরিধান যেমন একটি ‘শা’আয়ের’ বা ঐতিহ্যের প্রতীক, তেমনি একটি ইবাদতও বটে; হোক না তা মুস্তাহাব। উল্লেখ্য, টুপি পরিধান ইবাদত হওয়া প্রশ্নে স্তর বিবেচনায় মুস্তাহাব হলেও, ‘শা’আয়ের’ (মুসলিম জাতির ঐতিহ্যের প্রতীক বা ধর্মীয় ইউনিফর্ম হওয়ার বিবেচনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন শবেকদরের রাতে ইবাদত করা, নামে ‘মুস্তাহাব’ হলেও কার্যত তার গুরুত্ব ও মূল্যায়ন অনেক বেশি।
আরেকটি জ্ঞাতব্য বিষয় হলো, বৈধ-অবৈধ স্থিরকরণে আইনি নীতিমালা-
‘লেনদেন ও চুক্তির ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে ব্যাপক ‘অনুমতি’ ও ‘বৈধতা’... তবে, ইবাদতের ক্ষেত্রে এর বিপরীতটাই প্রযোজ্য, এক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছে (যোগ-বিয়োগ অতিরিক্ত কিছু) ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘অবৈধ হওয়া’, যতক্ষণ না বিধানদাতার পক্ষ থেকে সে বিষয়ে কোনো ‘নস’ (ঃবীঃ) বা দলিল প্রতিষ্ঠিত (পেশ করা) হয়, যাতে করে মানুষ ধর্মীয় ‘ইবাদত’ বিষয়ে এমন কিছুই প্রবর্তন না করে যার অনুমতি মহান আল্লাহ প্রদান করেননি।
সুতরাং টুপি পরিধান যেহেতু একটি ইবাদত, তাই আপনি তাতে ‘ড্রেস-কোড’ নামে হোক বা অন্য যে কোনো শিরোনামেই হোক; নিজের তরফ থেকে কিছু যোগ-বিয়োগ বা বাধ্যতামূলক করে দিতে পারেন না।
(৩). এ ছাড়া, পরিচয় বা চিনতে সুবিধা হওয়ার যে যুক্তি আপনি পেশ করেছেন, তার প্রয়োজনে- শিক্ষার্থী যার টুপি যেমনই হোক বা যার জামা-জুব্বা ইত্যাদি তাদের সুবিধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী যেমনই পরিধান করুক; তার ওপর বা একপাশে বা বুকের ওপর অথবা বাহুর ওপর ছাত্রের নামসহ প্রতিষ্ঠানের একটা নেইমপ্লেট থাকাই যথেষ্ট হতে পারে। অর্থাৎ নেইমপ্লেট ও প্রতিষ্ঠানের ‘লোগো’ একসঙ্গে যেকোনোভাবে থাকলেই হলো। বিশেষ কায়দায় টুপি হওয়া লাগবে কেন বা বিশেষ কায়দার জামা-জুব্বা বাধ্যতামূলক হওয়া লাগবে কেন? মোটকথা-
এসব ক্ষেত্রে বরং হাদিসাংশ- ‘তোমরা ধর্মকে সহজ কর, কঠিন করবে না এবং জনগণকে সুসংবাদ ও অনুপ্রেরণা দাও, ঘৃণা ও দূরে সরিয়ে দেবে না’- এই ‘নীতিমালা’ই অনুসরণ করা চাই।
‘দুররে মুখতার’ গ্রন্থের সূত্রে উপরোল্লিখিত উদ্ধৃতি দ্বারা বোঝা যাচ্ছে, অলসতাজনিত কারণে টুপি ছাড়া নামাজ পড়া মাকরুহ; তবে ব্যতিক্রম হিসেবে বলা হয়েছে, যদি বিনয় প্রকাশার্থে অর্থাৎ আমি অধম তো টুপি মাথায় দেওয়ারই অযোগ্য- এই চেতনায় কেউ টুপি ছাড়া নামাজ পড়ে- সেক্ষেত্রে তা মাকরুহ হবে না।
কিন্তু কেউ যদি টুপি পরিধান বা টুপির প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে টুপি পরিধান না করে এবং এ অবস্থায় সালাত আদায় করে; তা হলে সেক্ষেত্রে তার ঈমানই থাকবে না, সালাত শুদ্ধ হওয়া না হওয়ার তো প্রশ্নই অবান্তর। কেননা শরিয়তে প্রমাণিত কোনো বিষয়-বিধান আইনগত বিবেচনায় ফরয/ওয়াজিব/সুন্নত/নফল-মুস্তাহাব কোনো একটা নামে পরিচিত হওয়া তত বড় কথা নয়; কেউ সুবিধা-অসুবিধাহেতু তা পালন করতে পারুক বা না পারুক; তাতে বিশ্বাস থাকা ও ভাব-ভক্তিই ‘ঈমান’ প্রশ্নে বড় বিষয়। তাই সালাত, সওম ইত্যাদির অনুরূপ যে বিষয়টি বা আমলটি পবিত্র কোরআন ও হাদিসে আছে; কিংবা টুপি-পাগড়ি ইত্যাদির মতো যে কাজটি রাসুল (সা.) করেছেন মর্মে প্রমাণিত, সেটিকে অস্বীকার করলে বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে; তাতে ঈমান নষ্ট হয়ে যায়; অথচ বিশ্বাস ঠিক রেখে সারা জীবন তা পালন না করলেও ঈমান নষ্ট হয় না।
যে কোনো কারণে সালাতরত অবস্থায় মাথা থেকে টুপি পড়ে গেলে, তা উঠিয়ে মাথায় না দেওয়ার চেয়ে বরং উঠিয়ে মাথায় দিয়ে দেওয়া উত্তমণ্ডমুস্তাহাব; নতুবা তা মাকরুহ বা অপছন্দনীয় বলে গণ্য হবে। তবে নামাজি ব্যক্তি যদি নিজের প্রতি হেয়জ্ঞান করে তা না ওঠায় এবং খালি মাথায় নামাজ শেষ করে; সেক্ষেত্রে আবার তা মাকরুহ বলেও গণ্য হবে না।
পাগড়ির মতো টুপির ব্যবহারও কেবল নামাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; তা বরং অন্য সময়েও ব্যবহার করা সমানভাবে প্রিয়নবী (সা.)-এর উত্তম আদর্শের অন্তর্গত। অবশ্য তুলনামূলক বিবেচনায় পাগড়ির চেয়ে টুপির গুরুত্ব অধিক।
লেখক : মুফতি, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ