জমিদারবাড়ি নাম শুনলেই যে কারো চোখের সামনে ভেসে উঠবে- বহুদিন আগের ভাঙাচোরা পলেস্তারা খসে যাওয়া দেওয়াল কিংবা দেওয়ালের গা বেয়ে গজিয়ে উঠেছে বটগাছ অথবা মানবশূন্য ভূতুড়ে বাড়ি ইত্যাদি। কিন্তু মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলাধীন পৃত্থিমপাশা নবাববাড়ি বা জমিদারবাড়ির ক্ষেত্রে মিলেছে এর ভিন্নতা। প্রায় ৩৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্মৃত পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়িটি পুরোনো হলেও আজও সাজানো-গোছানো এবং পরিপাটি। প্রায় ২০০ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে- পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ি। বাড়ির সৌন্দর্যমণ্ডিত কারুকার্যময় আসবাবপত্র, বাড়ির সম্মুখে থাকা দৃষ্টিনন্দন মসজিদের ফুলেল নকশা, সুবিশাল দীঘি যেকোনো ভ্রমণপিপাসুকে আকৃষ্ট করবে। হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকবে বারংবার।
পৃত্থিমপাশায় রয়েছে দুটি জমিদারবাড়ি। এই বাড়ির ভেতরের সবকিছু পুরোনো আমলের কারুকাজ খচিত মনে হলেও সেগুলো পরিষ্কার ঝকঝকে এবং তকতকে। জমিদারদের ব্যবহার করা অনেক জিনিসপত্র রয়েছে এ বাড়িতে। বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণে এখানে লোকজন নিয়োজিত রয়েছে। জমিদারদের জমিদারি প্রথা আজ আর নেই, তবে রয়ে গেছে সুবিশাল বাড়ি এবং তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। জমিদারবাড়ির সামনের দীঘিতে রয়েছে তিনটি ছোট-বড় শান বাঁধানো ঘাট। এসব ঘাটে বসে পড়ন্ত বিকেলে গল্প, আড্ডা কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য উপযোগী। পশ্চিম পাড়ে জমিদারের সারিবদ্ধ স্থাপনা আর পূর্বপাড়ে পৃত্থিমপাশার সব জমিদার ও পরিবারের সদস্যদের কবরস্থান। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ বাড়িটি দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিনিয়ত ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনা থাকে এখানে।
জমিদারদের ইতিহাস : মোগল সম্রাট আকবরের সময়কালে ইরান থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আসেন সাকি সালামত খান। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই তার ছেলে ইসমাইল খান পৃত্থিমপাশায় আসেন। ইসমাইল খানের নামে পৃত্থিমপাশার জমিদারবাড়ির দিঘির নামকরণ করা হয়। ইসমাইল খানের ছেলের নাম শামসুদ্দিন খান। শামসুদ্দিন খানের ছেলে রবি খান। এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের জন্য জমি দান করে রবিরবাজার হাট প্রতিষ্ঠা করেন রবি খান। তার ছেলে আলী আহমদ খান সিলেটের কাজি (বিচারক) ছিলেন। একটি ঘরের চূড়ায় বিরাটাকায় একটি ঘড়ি স্থাপন করা হয়েছে। ১৮৭৪ সালে সিলেটের কীন ব্রিজের ডান পাশে সুরমা নদীর তীরে ঘড়িঘরটি নির্মাণ করেন আলী আহমদ খান। নাম রাখেন ছেলে আলী আমজাদের নামে। পরে পিতার মৃত্যুর পর স্থাপনাটির নির্মাণকাজ পূর্ণ করেন আলী আমজাদ খান। এটি এখন সিলেট শহরের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা। নারী শিক্ষার প্রসারে মৌলভীবাজারে ১৯০৫ সালে ‘মৌলভীবাজার আলী আমজাদ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন নবাব আলী আমজাদ খান। এ ছাড়া কুলাউড়ায় প্রতিষ্ঠা করা হয়- ‘আলী আমজাদ স্কুল অ্যান্ড কলেজ’।
আমজাদ খানের দুই উত্তরাধিকারী হলেন- আলী হায়দার খান ও আলী আজগর খান। তাদের আমলেই বাড়িটি দুই ভাগ হয়ে যায়। আলী হায়দার খানের দুই পুত্র- আলী ছফদর খান ওরফে রাজা সাহেব ও আলী সারওয়ার খান ওরফে ‘চুন্নু নবাব’। আলী ছফদর খান ভাসানী ন্যাপের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। অন্যজন আলী সারওয়ার খান ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন। স্বাধীনতাণ্ডপরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের উপনির্বাচনে কুলাউড়া আসনের প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, এলাকাটি এক সময় ত্রিপুরা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানকার শ্বাপদণ্ডসংকুল বন-বনানী ঘেরা পাহাড়ি এলাকায় নওগা কুকি উপজাতিদের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল। শ্রীহট্ট (সিলেট) সদরে সেই সময় মোহাম্মদ আলী নামে একজন কাজী ছিলেন। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ শাসকদের কর্তৃক নওগা কুকিদের বিদ্রোহ দমনে মোহাম্মদ আলী বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ইংরেজ সরকার এতে খুশি হয়ে মোহাম্মদ আলীর পুত্র গাউছ আলী খানকে ১২০০ হাল বা ১৪ হাজার ৪০০ বিঘা নিষ্কণ্টক জমি দান করেন। সে সময়ে বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে সবচেয়ে স্বনামধন্য এবং প্রভাবশালী অন্যতম জমিদার ছিলেন গাউস খার পৌত্র নবাব আলী আমজাদ খান। তিনি সমাজসেবক, দানশীল পরোপকারী জমিদার হিসেবে সারা বাংলা এবং আসামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।
কীভাবে যাবেন?
দেশের যেকোনো স্থান থেকে প্রথমে আপনাকে মৌলভীবাজার শহর আসতে হবে। অতঃপর সেখান থেকে বাস বা সিএনজিতে সরাসরি কুলাউড়া উপজেলায় যেতে হবে। তাছাড়া সিলেট ও ঢাকা থেকে সরাসরি রেলওয়ে পথে কুলাউড়া আসতে পারবেন। সেখান থেকে রবিরবাজার সংলগ্ন আপনার কাঙ্ক্ষিত পৃত্থিমপাশা জমিদারবাড়ি। যাতায়াতের ক্ষেত্রে গাড়ি ভাড়া আলোচনা সাপেক্ষে কথা বলে নিলেই ভালো। চাইলে রির্জাভ গাড়িতেও আপনি সেখানে যেতে পারবেন।
লেখক : শিক্ষার্থী শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজ