ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের ফজিলত ও জিয়ারত

মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
মদিনা শরিফের ফজিলত ও জিয়ারত

পৃথিবীর বুকে অত্যন্ত বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ শহর হলো মদিনাতুর রাসুল বা রাসুলের শহর। যা মদিনা শরিফ নামে সমধিক পরিচিত। যাকে আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় নবীর আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। যেখানে শায়িত রয়েছেন আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। মদিনার পূর্ব নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। আল্লাহতায়ালা বলেন, যখন তাদের একদল বলেছিল, হে ইয়াসরিববাসী। এখানে তোমাদের কোনো স্থান নেই। তোমরা ফিরে চল। তাদের একদল নবীর কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলেছিল, আমাদের বাড়িঘর অরক্ষিত, অথচ ওইগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পালায়ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। (সুরা আহযাব-১৩)।

মদিনা শরিফের রয়েছে একাধিক নাম। প্রত্যেকটা নামের সঙ্গে নিহিত রয়েছে এর মহত্ব ও মর্যাদা। হজরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.) ‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ নামক গ্রন্থে মদিনা শরিফের ছাপ্পান্নটি নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম নুর উদ্দিন সামহুদী তার ‘ওয়াফাউল- ওয়াফা’ নামক গ্রন্থে বলেন, মদিনা মুনাওয়ারার পঁচানব্বইটি নাম রয়েছে। তম্মধ্যে, সর্বাধিক প্রসিদ্ধ নাম হলো ‘মদিনা’। এর অর্থ হলো কতগুলো একত্রিত ঘর, ঘনবসতি। ইমানদারের কাছে এর নাম মদিনা মুনাওয়ারাহ্। আল্লাহতায়ালা বলেন, তারা বলে, যদি আমরা মদিনায় ফিরে যাই, তাহলে অবশ্যই সেখান থেকে প্রবল দুর্বলকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু সব মর্যাদা তো আল্লাহর, তাঁর রাসুলের ও মোমিনদের। কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না। (সুরা মুনাফিকুন-৮)।

পবিত্র মক্কা নগরীর যেরকম মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী মদিনা শরিফও সেরকম নিরাপত্তা ও সম্মানের অধিকারী। মদিনাবাসীর বরকতের জন্য রাসুল (সা.) নিজেই দোয়া করতেন। হজরত আলী (রা.) বলেন, আমি প্রিয় নবীজির (সা.) সঙ্গে মদিনা থেকে বের হলাম। অতঃপর হজরত সাদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা.)-এর মালিকানাধীন ‘হারাতুস-সুকইয়া’ নামক স্থানে পৌঁছে তিনি অজু করলেন। এরপর তিনি কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে দোয়া করে বলেন, হে আল্লাহ! হজরত ইবরাহিম (আ:) তোমার বান্দা ও খলিল। তিনি মক্কাবাসীর প্রতি কল্যাণ ও বরকত নাজিলের জন্য দোয়া করেছিলেন। আমিও তোমার বান্দা ও রাসুল। আমি মদিনাবাসীর জন্য দোয়া করছি। ‘হে আল্লাহ! তাদের মুষ্ঠি ও পরিমাপে যে বরকত দান কর যেমন মক্কাবাসীকে দান করেছ। মদিনাবাসীকে মক্কাবাসীর তুলনায় দ্বিগুণ বরকত দান কর। (তিরমিজি-৩৯১৪)।

হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) রাসুল (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, মদিনার এখান থেকে সেখান পর্যন্ত হারাম বা মহাসম্মানিত। এখানকার কোনো গাছ কাটা যাবে না, এখানে কোনো অসংগত কাজ করা যাবে না। যে ব্যক্তি এখানে তা করবে তার প্রতি আল্লাহর সব ফেরেশতা এবং সব মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হবে। (বোখারি-১৮৭০, মুসলিম-৪৬৩)।

আল্লাহতায়ালা রহমতের ফেরেশতা দ্বারা মদিনা শরিফকে যাবতীয় অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেন। এমনকি কেয়ামতের আগে সংঘটিত দাজ্জালের ফেতনা থেকেও আল্লাহতায়ালা মদিনা শহরকে রক্ষা করবেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলেপাক (সা.) বলেছেন, মদিনার প্রবেশ পথগুলোতে ফেরেশতারা পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে। এখানে মহামারি (প্লেগ) ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না। (বোখারি-১৭৫৯)। হজরত আবু বাকরা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, মসীহ দাজ্জালের ত্রাস ও ভয়ভীতি মদিনায় প্রবেশ করবে না। সে সময় মদিনার সাতটি প্রবেশ পথ থাকবে এবং প্রত্যেক প্রবেশপথে দু’জন করে ফেরেশতা থাকবে। (বোখারি-১৮৭৯)।

পবিত্র মদিনা শরিফে ইন্তেকাল করলে তার জন্য হাশরের ময়দানে প্রিয় নবীজির সুপারিশ লাভ করার সুসংবাদ রয়েছে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) বলেন, প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম, সে যেন সেখানেই মৃত্যুবরণ করে। কেননা, যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করবে আমি তার জন্য সুপারিশ করব। (তিরমিজি, ৩৯১৭, ইবনে হিব্বান-৩১৪১)।

ঐতিহাসিক হাররার ঘটনার সময় আবু সাঈদ মাওলা আল মাহরি হজরত আবু সাঈদ খুদুরির (রা.) এর কাছে এসে মদিনা থেকে অন্যত্র চলে যাওয়ার জন্য পরামর্শ চাইলেন। তিনি অভিযোগ করলেন, মদিনার আসবাবপত্র ও পণ্যের দাম বেশি এবং তার সন্তান-সন্ততির সংখ্যাও প্রচুর। এও বললেন, মদিনার এ দুঃখ ও কষ্টে ধৈর্যধারণ করার ক্ষমতা তার নেই। আবু সাঈদ খুদুরি (রা.) তাকে বললেন, আফসোস! তোমাকে এ পরামর্শ দিতে পারি না। কারণ, আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মদিনার দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যধারণ করে এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করে কেয়ামতের দিন আমি তার জন্য সুপারিশকারী বা সাক্ষী হবো, যদি সে মুসলিম হয়। (মুসলিম-৩৪০৫)।

মদিনা শরীফের মসজিদে নববী হলো প্রিয় নবিজীর (সা.) এর হাতে গড়া মসজিদ যা বিশ্ব মুসলিমের কাছে অত্যন্ত ফযিলত ও বরকতের। সেখানে রয়েছে ‘রিয়াজুল জান্নাত’ বা জান্নাতের বাগান। প্রিয় নবিজী বলেন, আমার ঘর ও আমার মিম্বরের মাঝখানে বেহেশতের বাগান সমূহের মধ্যে থেকে একটি বাগান আছে। (বোখারি)। অপর হাদিসে নবিজী বলেন, আমার মিম্বর বেহেশতের দরজায় অথবা বেহেশতের উচ্চ বাগানে অবস্থিত। হাদিসে বিশারদগণ বলেন, দুনিয়াতে যে মিম্বরের উপর হুজুর আকরম (সা.) উপবেশন করতেন, সে মিম্বর খানাকে তার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধির খাতিরে কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারের পাড়ে নিয়ে আসা হবে।

প্রিয় নবিজির রওজা পাক জিয়ারত করা নিঃসন্দেহে সুন্নাত ও পূর্ণময় কাজ। মালেকী মাযহাবের কোন কোন ইমাম এটিকে ওয়াজিবের কাছাকাছি বলেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত,রাসূল সা. এরশাদ করেছেন, যে আমার ওয়াফাতের পর হজ করলো অতঃপর আমার কবর জিয়ারত করতে আসলো সে যেন আমার জীবিত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করলো। (বায়হাকী- ৩৮৫৫)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করলো তার জন্য আমার সুপারিশ আবশ্যক হয়ে গেল। (দারা কুতনি-১৯৪)

আল্লাহ তাআলা বলেন,আল্লাহর অনুমতিক্রমে কেবলমাত্র আনুগত্য করার জন্যই আমরা রাসূলদের প্রেরণ করেছি। যখন তারা নিজেদের প্রতি যুলুম করে তখন তারা আপনার কাছে আসলে ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং রাসূলও তাদের জন্য ক্ষমা চাইলে তারা অবশ্যই আল্লাহকে পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালুরূপে পাবে। (সুরা নিসা-৬৪)

এক বেদুঈন পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি শুনতে পেয়ে দ্রুত মদিনা শরীফ রওনা হলেন এই উদ্দেশ্যে যে, প্রিয় নবি কে (সা.) কে বলে তিনি তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ আল্লাহর কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেবেন। বেদুঈন লোকটি মদিনা শরীফে এসে জানতে পারলেন,কিছু দিন হলো প্রিয় নবিজী (সা.) ওফাত প্রাপ্ত হয়ে হায়াতে জিন্দেগী থেকে পর্দা করেছেন। তিনি নবিজী (সা.) এর রওজায় কাঁদতে কাঁদতে এই বলে ফরিয়াদ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সা.) ‘আমি পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতটি শুনতে পেয়ে অনেক আশা নিয়ে আপনার খেদমতে এসেছি আপনার শাফায়াতের মাধ্যমে আমি আমার সব গুনাহ আল্লাহর কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেব বলে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য,আমি আপনাকে পেলাম না, তাই অত্যন্ত ভগ্ন হৃদয়ে আপনার দরবার থেকে ফিরে যাচ্ছি। ’

এ বলে তিনি কাঁদতে কাঁদতে নবিজী (সা.) এর দরবার থেকে ফিরে যাচ্ছিলেন। হজরত আতবী (রা.) নামের একজন সাহাবি নবিজীর (সা.) এর রওজা প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে ছিলেন। নবিজী (সা.) তাকে স্বপ্নে ডাক দিয়ে বললেন,‘ওহে আতবী,আমার এক উম্মত অত্যন্ত নিরাশ হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে আমার দরবার থেকে ফিরে যাচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি তার পেছনে যাও এবং তাকে গিয়ে বল,নবিজী (সা.) তোমার ফরিয়াদ শুনেছেন এবং আল্লাহর দরবারে তোমার জন্য শাফায়াত করিয়েছেন। তুমি সন্তুষ্টচিত্তে বেহেশতের সুসংবাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাও। (তাফসিরে ইবনে কাসির)

লেখক : সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা)

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত