ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দরিয়া-ই-নূর বাঙলার হীরা

রাজিত তাহমীদ জিতু
দরিয়া-ই-নূর বাঙলার হীরা

সুলতান-ই বাঙ্গালাহ্ শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ গাজী (রহ.)-এর বিখ্যাত হীরা ‘দারিয়া-ই-নূর’ (নূরের সমুদ্র), যা শোভা পেত তার মুকুটে। ১৩৫২ সালে ত্রিপুরার বিতাড়িত রাজপুত্র রত্ন ফা সাহায্য প্রার্থনা করলেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহর কাছে রাজ্য উদ্ধারের জন্য। সুলতান ত্রিপুরা দখলের জন্য সেনাবাহিনী পাঠালেন ও রাজা দেব ফা ও তার ১৬ জন ভাইকে পরাজিত ও নিহত করে সহজেই ত্রিপুরার দখল নিলেন।

সুলতান রত্ন ফাকে সিংহাসনে বসালেন ও বিশাল এক বাহিনী গঠন করে একজন সেনাপতিকে ত্রিপুরার সামরিক শাসক নিযুক্ত করে তাকে মোতায়েন করলেন সমতল ত্রিপুরার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র কসবায় (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত)। এইভাবেই ১৩৫২ ঈসায়িতে ত্রিপুরা রাজ্য যা কখনও মুসলমানদের অধীনে আসেনি, তা প্রথমবারের মতো বাঙালিদের সুলতান ইলিয়াস শাহর নেতৃত্বে মুসলমানদের অধীনে আসে ও বাঙ্গালা সালতানাতের প্রদেশে পরিণত হয়।

মহারাজ রত্ন ফা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মহামান্য বাদশাহকে উপহার প্রদান করলেন বহুমূল্য ‘দরিয়া-ই-নূর’ (আলোর সমুদ্র) হীরকখণ্ড। সেই যুগে ত্রিপুরা ছিল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। এই দরিয়া-ই-নূর-ই পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ও দ্বিতীয় মূল্যবান হীরক। ইলিয়াস শাহ্ রত্ন ফা কে ‘মানিক্য’ উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে ত্রিপুরার রাজারা নামের শেষে ‘মানিক্য’ ব্যবহার করে থাকে।

‘দরিয়া-ই-নূর’ হীরা ছিল বাংলার সুলতানদের নিত্যব্যবহার্য রাজদ্রব্য। যিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতেন তিনি এই হীরক মুকুট পরিধান করতেন। এটি ছিল বাংলার সুলতানের প্রতীকস্বরূপ, অর্থাৎ, সিংহাসনে যিনি আসীন হতেন তিনিই এই হীরার মালিক হতেন। অনেকটা উসমানিয়দের উসমান গাজীর তরবারির মতো। উসমানিয়রা যেমন সিংহাসনে বসলেই তাদের অভিষেক হতো উসমান গাজীর তলোয়ার হাতে নিয়ে, ঠিক তেমনি বাংলার সুলতানের সিংহাসন অভিষেক হতো এই হীরা মুকুটে পরিধান করে। ১৫৭৬ সালে সম্রাট আকবর বাংলা সাম্রাজ্যের পতন ঘটানোর পর বাংলা দখল করে নিল, তখন এটি মুঘলদের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তবে ক্রুদ্ধ বাঙালিরা ১৫৭৬ সালে পরাজয়ের পর একটি কথা গুজবের মতো চরমভাবে রটিয়ে দিয়েছিল যে, ‘বাংলার স্বাধীন সুলতান বাদে অন্য কেউ এই হীরা ব্যবহার করলে তাকে তার রাজ্য ও জীবন হারাতে হবে।’

তাই মুঘল বাদশাহরা হীরাটির মালিক হলেও ব্যবহার করেননি। এটি সুবাহ বাংলার রাজকোষাগারে সংরক্ষিত ছিল। পরবর্তী সময়ে নবাবি আমলে এটি নবাবদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। তবে নবাবরা যেহেতু স্বাধীন-সার্বভৌম শাসনকর্তা ছিলেন না, তাই স্বাধীন শাসকের মতো মুকুট ব্যবহারের অধিকারও তাদের ছিল না। যদি তারা তা করতেন, তা হতো মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। তাই এই হীরাও নবাবরা মুকুটে পরেননি। পরে মুর্শিদকুলী খান তার কন্যার বিয়েতে এই হীরা জামাতা উড়িষ্যার নায়েব নাজিম রুস্তম জঙ্গকে যৌতুক হিসেবে প্রদান করেন। আলীবর্দী খান ১৭৪১ সালে সরফরাজ খাঁকে উৎখাত করলে রুস্তম জঙ্গ হায়দ্রাবাদে আশ্রয় নেন ও চরম অভাবে পড়ে নামমাত্র মূল্যে মাত্র ১ লাখ ৩০ হাজার রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে এই হীরাটি নিজামের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিক্রয় করে দেন।

নিজাম শাহির সঙ্গে মারাঠাদের যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর প্রাসাদ লুটের শিকার হলে এটি মারাঠাদের হস্তগত হয়। ১৭৬১ সালের পানিপথের যুদ্ধে জয়ী হয়ে পেশোয়া বালাজি বাজি রাওয়ের কাছ থেকে হীরাটি আহমাদ শাহ আবদালীর হস্তগত হয়। আহমাদ শাহ্ দুররানী নাদির শাহের কোষাগার লুট করে ‘কোহ-ই-নূর’ ও অধিকার করে নেন। দরিয়া-ই-নূরের নামানুসারেই কোহ-ই-নূরের নামকরণ করেছিল মুঘলরা। কিন্তু শিখদের আক্রমণে লাহোর দখল হয়ে গেলে হীরা দুটো শিখদের হস্তগত হয় ও দরিয়া-ই-নূরকে লাহোর কোষাগারের বৈভব ঘোষণা করা হয়। শিখ সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হলে ‘দরিয়া-ই-নূর’ ইংরেজদের দখলে আসে।

ইংরেজরা ১৮৫২ সালে হীরাটি নিলামে তুললে পূর্ববঙ্গের শ্রেষ্ঠ ধনী অভিজাত ব্যক্তি ঢাকার জমিদার আলীমুল্লাহ এটি কিনে নেন। ১৮৫৪ সালে খাজা আব্দুল গনী জমিদার হন ও সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজ আনুগত্যের জন্য ‘নবাব’ উপাধিপ্রাপ্ত হন। এটি ঢাকার নবাব পরিবারের সম্পত্তিতে পরিণত হয়। আহসান মঞ্জিলের বারান্দায় সোনায় বাঁধানো ১টি খাতা রাখা হতো, কারণ এই দরিয়া-ই-নূর দেখার জন্য দেশি-বিদেশি বহু অভিজাত ব্যক্তি ঢাকায় তার প্রাসাদে আসত। তাদের মন্তব্য করার জন্যেই এই খাতা রাখা হয়, ১৮৮৮ সাল লর্ড ডাফরিন ও তাঁর পত্নী ঢাকায় আহসান মঞ্জিলে বিশেষ সফরে এসেছিলেন শুধু এই দুর্লভ হীরা দেখার জন্যই।

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ খানের সময়ে নবাব পরিবার ধীরে ধীরে প্রতিপত্তি হারাতে থাকে ও অর্থকষ্টে একসময় হীরাটি ইংল্যান্ডের রাজা-রানির কাছে বিক্রির জন্য কলকাতায় পাঠালেও রানি মেরির এটি পছন্দ হয়নি। কিন্তু রাজা জর্জ দ্য ফিফথ হীরাটি দেখে একে অমূল্য ও প্রত্ন মূল্যের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ১৯১৫ সালে খাজা সলিমুল্লাহ ইন্তেকাল করলে ঢাকার নবাবদের প্রতিপত্তি যথেষ্ট হ্রাস পায় ও হীরাটি হ্যামিল্টন কোম্পানির তত্ত্বাবধানে কলকাতায় সংরক্ষিত থাকে। ৩৭ বছর কলকাতায় থাকার পর পরবর্তী ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহর উদ্যোগে দরিয়া-ই-নূরকে আবার ঢাকায় আনা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ সালে মখমলের কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটি লোহার বাক্সে ভরে জমা প্রদানকারীর সামনে তাতে সিলগালা লাগিয়ে ৬টি দুষ্প্রাপ্য মুক্তাসহ ঢাকায় আনা হয়।

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান সোনালী ব্যাংকে পরিণত হয়। ঢাকার নবাব পরিবারের একাধিক উত্তরসূরির জন্য হীরাটির কোনো সুরাহা হচ্ছিলো না। তখন ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর নবাব পরিবারের অন্যান্য মূল্যবান ধনরত্নের সঙ্গে হীরাটি সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু কিছুদিন পর প্রেসিডেন্ট জিয়ার ইন্তেকালের পর আর কেউ-ই এই হীরাটি ব্যাপারে এগিয়ে আসেনি। হীরকখণ্ডটি সোনালী ব্যাংকে সংরক্ষিত ছিল।

এই হীরাটিই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান হীরা, ‘কোহ-ই-নূরে’র পর। সম্প্রতি দুর্নীতিগ্রস্ত সোনালী ব্যাংক হীরাটি গায়েব করে দিয়েছে; হীরাটি সোনালী ব্যাংকে সংরক্ষিত ছিল, সম্প্রতি এটির সন্ধান অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে দাবি উঠেছে, অর্থাৎ বাংলাদেশের এই দুর্লভ রাষ্ট্রীয় সম্পদটি পাচারের শিকার হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত