ইসলাম ধর্মে পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির অন্যতম সহায়ক হিসেবে সালামকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কেননা, সালামের মাধ্যমে পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মহান আল্লাহতায়ালাও একে অপরকে সালাম দিতে নির্দেশ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন : হে মোমিনরা, তোমরা নিজেদের গৃহ ছাড়া অন্য কারও গৃহে প্রবেশ করো না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি নেবে এবং গৃহবাসীদের সালাম দেবে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো। (সুরা নূর : ২৭)।
আল্লাহতায়ালা আরও বলেন : যখন তোমরা গৃহে প্রবেশ করবে, তখন তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এ হবে আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র অভিবাদন (সুরা নূর : ৬১)। তিনি অন্য আয়াতে বলেন : আর যখন তোমাদের সালাম দেয়া হবে তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে। অথবা জবাবে তাই দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে পূর্ণ হিসাবকারী। (সুরা নিসা : ৮৬)।
মহান আল্লাহতায়ালা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন : তোমার কাছে কি ইবরাহীমের সম্মানিত মেহমানদের বৃত্তান্ত এসেছে?
যখন তারা তার কাছে আসল এবং বলল, ‘সালাম’, উত্তরে সেও বলল, ‘সালাম’। (সুরা যারিয়াত : ২৪-২৫)।
মুসলিম উম্মাহর কাছে সালামের গুরুত্ব বোঝাতে এবং পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধিতে সালামের ব্যাপক প্রচলনে উদ্বুদ্ধ করতে হাদিসে এরশাদ হয়েছে : আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত ঃ এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, ইসলামের কোন কাজটি উত্তম? তিনি জবাব দিলেন, তুমি (ক্ষুধার্তকে) অন্নদান করবে এবং পরিচিত ও অপরিচিত সবাইকে সালাম দেবে। (বোখারি : ১২, ২৮, ৬২৩৬, মুসলিম : ৩৯, তিরমিজি : ১৮৫৫, নাসায়ি : ৫০০০, আবু দাউদ : ৫১৫৪, ইবনু মাজাহ : ৩২৫৩, ৩৬৯৪, আহমাদ : ৬৫৪৫, ৬৮০৯, দারেমি : ২০৮১)।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ যখন আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন। তখন তাঁকে বললেন, তুমি যাও এবং ওই যে ফেরেশতামণ্ডলীর একটি দল বসে আছে, তাদের ওপর সালাম পেশ কর। আর ওরা তোমার সালামের কী জবাব দিচ্ছে তা মন দিয়ে শুনো। কেননা, ওটাই হবে তোমার ও তোমার সন্তান-সন্ততির সালাম বিনিময়ের রীতি। সুতরাং তিনি (তাদের কাছে গিয়ে) বললেন, আসসালামু আলাইকুম। তারা উত্তরে বললেন, আসসালামু আলাইকা ওয়া রহমাতুল্লাহ। অতএব তারা ‘ওয়া রহমাতুল্লাহ’ শব্দটা বেশি বললেন। (রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ৮৫০, বোখারি : ৩৩২৬, ৬২২৭, মুসলিম ২৮৪১, আহমাদ ৮০৯২, ১০৫৩০, ২৭৩৮৮)।
আবু হুরাইরা (রা.) থেকে আরও বর্ণিত ঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর যতক্ষণ না তোমাদের পারস্পরিক ভালোবাসা গড়ে উঠবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা প্রকৃত ঈমানদার হতে পারবে না। আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি কাজ বলে দেব না, যা করলে তোমরা একে অপরকে ভালবাসতে লাগবে? (তা হচ্ছে) তোমরা নিজেদের মধ্যে সালামের ব্যাপক প্রচার কর। (মুসলিম : ৫৪, তিরমিজি : ২৬৮৮, আবু দাউদ : ৫১৯৩, ইবনু মাজাহ : ৬৮, ৩৬৯২, আহমাদ : ৮৮৪১, ৯৪১৬, ৯৮২১, ১০২৭২, ২৭৩১৪, রিয়াদুস সলেহিন : ৮৫২)।
পারস্পরিক সুসম্পর্ক বৃদ্ধিতে সালাম এতটাই তাৎপর্য বহন করে যে, শিশুদের মধ্যেও সালামের প্রচলনের জন্য হাদিসে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এরই লক্ষ্যে হাদিসে শিশুদেরও সালাম দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, যাতে করে শিশুরাও সালাম দেওয়ায় বা সালাম আদান প্রদানে অভ্যস্ত হতে পারে। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত ঃ তিনি কতিপয় শিশুর কাছ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাদের সালাম দিলেন এবং বললেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরূপ করতেন। (বোখারি : ৬২৪৭, মুসলিম : ২১৬৮, তিরমিজি : ২৬৯৬, আবু দাউদ : ৫২০২, ইবনু মাজাহ : ৩৭০০, আহমাদ : ১১৯২৮, ১২৩১৩, ১২৪৮৫, ১২৬১০, দারেমি : ২৬৩৬, রিয়াদুস সলেহিন : ৮৬৭)।
একটি সমাজে যখন পারস্পরিক ভালোবাসার সম্পর্ক বিরাজমান থাকে না, তখন জন্ম হয় অহংকার, হিংসা ও লোভসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের, যা ওই সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই সর্বস্তরে, সবার মাঝে সালামের ব্যাপক প্রচলন করা উচিত। ইদানীং পরিলক্ষিত হয়, আমাদের সমাজে যারা সালামের আদান-প্রদান করে তাদের মধ্যে বৃহৎসংখ্যক আবার শুদ্ধভাবে সালামটাও দিতে পারে না। সেলামালাইকুম, আলিকুম সালাম, ছাকুম, অকুম, সালাইমালাইকুম, ওয়ালাইকুম ইত্যাদি বলে সালামকে বিকৃতি করে একে অপরের মাঝে উপস্থাপন করে। এই ধরনের শব্দ বা বাক্যকে বিকৃতি করে সালাম হিসেবে আবার শিক্ষিত সমাজের একটি বড় অংশ, যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত তারাও একে অপরের মাঝে আদান প্রদান করছে, যা আসলেই হতাশাজনক এবং এ ধরনের বিকৃতির ফলে অর্থ পরিবর্তন হয়ে সওয়াবের বদলে গোনাহগার হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে।
সালাম কীভাবে আদান প্রদান করতে হবে বা কোনো বাক্য ব্যবহার করে সালাম দিতে হবে এ বিষয়ে হাদিসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত ঃ তিনি বলেন, একটি লোক নবী (সা.) এর কাছে এসে এভাবে সালাম করল ‘আসসালামু আলাইকুম’ আর নবী (সা.) তার জবাব দিলেন। অতঃপর লোকটি বসে গেলে তিনি বললেন, ওর জন্য দশটি নেকি। তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তি এসে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ’ বলে সালাম পেশ করল। নবী (সা.) তার সালামের উত্তর দিলেন এবং লোকটি বসলে তিনি বললেন, ওর জন্য বিশটি নেকি। তারপর আর একজন এসে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারোকাতুহ’ বলে সালাম দিল। তিনি তার জবাব দিলেন। অতঃপর সে বসলে তিনি বললেন, ওর জন্য ত্রিশটি নেকি। (তিরমিজি : ২৬৮৯, আবু দাউদ : ৫১৯৫, আহমাদ : ১৯৪৪৬, দারেমি : ২৬৪০, রিয়াদুস সলেহিন : ৮৫৫)।
মূলত ইসলাম মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ভালোবাসা ও সম্প্রীতির সম্পর্ককে ত্বরান্বিত করতে সালাম আদান প্রদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছে, যা কোরআন ও হাদিস দ্বারা প্রতিয়মান হয়। সুতরাং আসুন পারস্পরিক সালাম আদান প্রদান করি, ভালোবাসা- সম্প্রীতির সমাজ গড়ি।
লেখক : শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ,
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া