ঢাকা শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫, ১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আলী হাসান তৈয়ব
ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ইলম আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো- জ্ঞান বা শিক্ষা (Knowledge বা Education)। ইসলামি শিক্ষা তথা কোরআনি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহতায়ালা একদল লোককে এর জন্য নিয়োজিত হওয়ার নির্দেশ দেন। এরশাদ করেন, ‘অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দ্বীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদের সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গোনাহ থেকে) বেঁচে থাকে।’ (সুরা আত-তাওবা : ১২২)।

পবিত্র কোরআনের বর্ণনাভঙ্গিতেও শিক্ষার অপরিসীম গুরুত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেমন নিচের আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘পরম করুণাময়। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’ (সুরা আর-রহমান : ১-৪)।

আয়াতে করুণাময় মানুষকে দেয়া তাঁর তিনটি নেয়ামতের কথা বলেছেন। কোরআন শেখানো, মানুষকে সৃষ্টি করা এবং তাকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া। সাধারণভাবে বললে বলা হতো, মানুষ সৃষ্টি করেছেন তারপর তাকে কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ সৃষ্টি করার আগে কোরআন শিক্ষা দেয়ার কথা বলা থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, দয়াময় আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন তবে যারা কোরআন তথা কোরআনি শিক্ষা পায়নি তাদের যেন মানুষই গণ্য করেননি তিনি।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলছেন যে, তিনি তাঁর রাসুলুকে যে দায়িত্বগুলো দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার একটি হলো শিক্ষা বিতরণ করা এবং কোরআন শিক্ষা দেওয়া। এরশাদ হয়েছে, ‘যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসুলু প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে, তোমাদের পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদের শিক্ষা দেয় এমন কিছু, যা তোমরা জানতে না।’ (সুরা আল-বাকারা : ১৫১)।

একই বিষয়ে অপর সুরায় বলা হয়েছে, ‘তিনিই উম্মিদের মাঝে একজন রাসুলু পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতগুলো, তাদের পবিত্র করে এবং তাদের শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহিতে ছিল।’ (সুরা আল-জুমুআ’ : ০২)।

সুফয়ান ইবন উয়াইনা (রহ.)-কে ইলমের মর্যাদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তোমরা কি আল্লাহর বাণীর প্রতি লক্ষ্য করো না, তিনি তো কী দিয়ে শুরু করেছেন? ‘অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মোমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং নিবাস সম্পর্কে অবগত রয়েছেন।’ (সুরা মুহাম্মদ : ১৯)।

এ আয়াতে আল্লাহ আমলের কথা বলেছেন ইলমের পরে। ইলম হলো নূর, যা দিয়ে মানুষ নানা বিষয়ের হাকিকত ও তাৎপর্য দেখতে পায়। এ দৃষ্টি ঠিক চোখের দৃষ্টি নয়। বরং অন্তরচক্ষু। আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি জমিনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের হতো এমন হৃদয়, যা দ্বারা তারা উপলব্ধি করতে পারত এবং এমন কান, যা দ্বারা তারা শুনতে পারত। বস্তত চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।’ (সুরা আল-হজ্জ : ৪৬)।

এ জন্য আল্লাহ মানুষকে দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। একদল আলিম (জ্ঞানবান) অন্যদল অন্ধ (জ্ঞানহীন)। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি জানে তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি যা নাজিল হয়েছে, তা সত্য, সে কি তার মত, যে অন্ধ? বুদ্ধিমানরাই শুধু উপদেশ গ্রহণ করে।’ (সুরা আর-রা’দ : ১৯)।

ইলম মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করে। আর আল্লাহভীতিই পারে মানুষকে যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখতে। আল্লাহ বলেন, ‘আর এমনিভাবে মানুষ, বিচরণশীল প্রাণী ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও রয়েছে নানা বর্ণ। বান্দাদের মধ্যে শুধু জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে। নিশ্চয় আল্লাহ মহাপরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল।’ (সুরা আল-ফাতির : ২৮)।

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘বল, তোমরা এতে ঈমান আন বা ঈমান না আন, নিশ্চয় এর আগে যাদের জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের কাছে যখন এটা পাঠ করা হয়, তখন তারা সিজদাবনত হয়ে লুটিয়ে পড়ে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল : ১০৭)।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান তাকে তিনি দ্বীন সম্পর্কে প্রাজ্ঞতা দান করেন।’ (বোখারি : ৫৬৪৫; মুসলিম : ২৪৩৬)।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার এ মসজিদে আসবে একমাত্র কল্যাণ অর্জনের জন্য যা সে শিখবে বা শেখাবে, সে আল্লাহর পথে মুজাহিদের স্তরে। আর যে এ ছাড়া অন্য উদ্দেশে আসবে, সে ওই ব্যক্তির স্তরে যে অন্যের বস্তুর প্রতি তাকায়।’ (ইবন মাজাহ : ৬৪৭২, হাদিসটি সহিহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে)।

প্রয়োজনীয় ইলম সবার জন্যই ফরজ। আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুøাল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘ইলম শিক্ষা করা প্রতিটি মানুষের ওপর ফরজ।’ (ইবন মাজাহ : ২২৪)। শুধু তাই নয় আমরা দেখতে পাই, শেষ নবীর ওপর অবতীর্ণ প্রথম ওহিতেই বলা হয় ‘পড়’।

শুধু শিক্ষা অর্জন বা জ্ঞানার্জন করলেই হবে না, তা হতে হবে রব বা প্রতিপালক তথা আল্লাহকে সন্তুষ্টির নিমিত্তে। আমাদের গলদ আজ এখানেই। সবাই উপলব্ধি করছি পড়ার গুরুত্ব। সবাই গাইছি শিক্ষা ও বিদ্যার মাহাত্ম্য। অথচ এর সঠিক লক্ষ্যের কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছি। রাসুলুুল্লাহ (সা.) এর বাণীগুলোর দিকে তাকালেও আমরা এমন ধারণা পাই। আলহামদুলিল্লাহ, মুসলিম ভাইবোনেরা এখনও একথা স্বীকার করেন যে, ইসলামেই শিক্ষার প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আলবৎ ঠিক। একেবারে হক কথা। কিন্তু শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আমরা যত বলছি, এর উদ্দেশ্য ও অর্জন নিয়ে ততটা বলছি না। এর ফলাফল নিয়ে ভাবছি না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে উপকারী জ্ঞান শেখার এবং সে অনুযায়ী আমলের তৌফিক দিন। আমাদের সবাইকে তাঁর দ্বীনের ইলম প্রচারে খাদেম হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত