ঢাকা মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপুরুষ

শরিফ আহমাদ
মাওলানা তর্কবাগীশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপুরুষ

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.) ছিলেন ভারতবর্ষের একজন বিদগ্ধ চৌকস রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন সুসাহিত্যিক ও সুবক্তা। বাংলাদেশিদের চেতনায় উজ্জীবিত একটি নাম। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নদ্রষ্টা। বাঙালির প্রাণপুরুষ। স্বীয় কর্মগুণ আর অসীম সাহসিকতার জন্য ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। সংগ্রামী এই জ্ঞানসাধকের জীবন ডায়েরি থেকে সামান্য কিছু অংশ নিচে তুলে ধরা হলো।

জন্ম ও শিক্ষা : মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.) ১৯০০ সালে ২৭ নভেম্বর পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার উল্লাপাড়া থানাধীন তারুটিয়া গ্রামে এক পীর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু ইসহাক ও মাতার নাম বেগম আজিজুন নেছা। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.)-এর লেখাপড়ার হাতেখড়ি পরিবারেই হয়। কারণ তার পিতা আবু ইসহাক (রহ.) ছিলেন সুখ্যাত এক আধ্যাত্মিক পরিবারের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি যুক্ত প্রদেশের বেরেলি ইশতুল উলুম মাদ্রাসা, সাহারানপুর মাদ্রাসা, দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে ইসলামি সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। লাহোরের এশাতুল ইসলাম কলেজে অধ্যয়ন করে তর্কশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে তিনি তর্কবাগীশ উপাধিতে ভূষিত হন।

কর্মজীবন ও রাজনীতি

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.) ছিলেন দরদি এক সংগ্রামী স্বপ্নপুরুষ। নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। তিনি মা, মাটি ও মানুষের জন্য রাজনীতি করতেন। মূলত উদ্দীপ্ত তরুণ বয়স থেকে তার মধ্যে দেশপ্রেমের তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও ঝোঁক ছিল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে অসহায় দুধ বিক্রেতাদের সুসংগঠিত করে দুধের ন্যায্য মূল্য প্রদানে মহাজনদের বাধ্য করেন।

১৯১৯ সালে তিনি খেলাফত আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন ? ১৯২২ সালে ২২ বছর বয়সে তিনি বিলেতি পণ্য বর্জনে সলংগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। রক্তক্ষয়ী এই আন্দোলনের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল?। এই আন্দোলনে ব্রিটিশদের ভিত নড়ে ওঠে। তাই সলংগা আন্দোলন পরবর্তীতে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে রক্ত সিঁড়ি হিসেবে সুপরিচিত। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ১৯৩৩ সালে রাজশাহীর চাঁটকৈড়ে নিখিল বঙ্গ খাতক সম্মেলন আহ্বান করে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব রাখেন। তিনি ১৯৩৭ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নাটোরে কৃষক সম্মেলন আহ্বান করেন এবং তিনি ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ১৯৩৮ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে বাংলা, আসাম ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত বাংলার এমএলএ হিসেবে তৎকালীন ব্যবস্থাপক পরিষদে পতিতাবৃত্তি নিরোধ, বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ও বিনা ক্ষতি পূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে ছাত্রজনতার ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করেন এবং পরে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্য হিসেবে পাকিস্তান গণপরিষদে ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি প্রথম রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করার রেকর্ড গড়েন। তিনি প্রথম বাংলার সম্মান উঁচু করার ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

গুরু-শিষ্যের রাজনীতি

দুইজন মাওলানা জাতি গঠনের ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছেন। বাঙালিদের প্রতিটি আন্দোলনে রয়েছে তাদের অসীম ত্যাগ ও অবদান। এদুজনই আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু। একজন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (রহ.) অন্যজন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.) মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ছিলেন একজন সংগ্রামী সাধক। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তেজস্বী ছিল তার ভাষণ। যে ভাষণের সীমাহীন ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সৈয়দ আনোয়ার আব্দুল্লাহ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে স্বপ্ন দেখতেন তিনি একদিন তর্কবাগীশের মতো বক্তৃতার মন্ত্রে বাঙালি জাতির সুপ্তি ভাংবেন। ১৯৫৬-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটানা ১০ বছরের অধিক সময়ে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন যুগ্ম সম্পাদক। পরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তর্কবাগীশের সঙ্গে।? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে তর্কবাগীশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছিল। তার রাজনৈতিক দর্শন, বক্তৃতার কলাকৌশল, মানুষের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার দৃষ্টান্ত, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম সবই ছিল তর্কবাগীশের প্রভাবে আচ্ছন্ন। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর নাতি সৈয়দ হাদী তর্কবাগীশ অগ্নিগর্ভে একুশ প্রবন্ধে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যেদিন প্রথম তর্কবাগীশের সঙ্গে দেখা করেন সেদিন বলেছিলেন, নেতা আমি আপনার মতো বক্তা হতে চাই। সত্যি তিনি পরবর্তীতে এমন এক বক্তৃতা দেন, যা তর্কবাগীশের বক্তৃতাকে হার মানাল। ৭ মার্চের বক্তৃতায় তিনি গুরুর মতো এক কিংবদন্তি ভাষণে জাগ্রত করলেন পুরো জাতিকে।? সেই ভাষণ পৃথিবীর সেরা একটি ভাষণে পরিণত হলো। এটা এখন একটি কালজয়ী কবিতা। দেশপ্রেমে গর্জে ওঠার অমর এক ইতিহাস।

অবদান ও ইন্তেকাল

মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.) ছিলেন মূলত নববি আদর্শে গড়া একজন মহামানব। ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি আমরণ স্বাধীন-সার্বভৌমত্ব দেশের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ যেমন রাজনীতির ময়দান দাপিয়ে বেরিয়েছেন, তেমন সাহিত্যাঙ্গণেও ছিলেন পথিকৃৎ। তার রচিত গ্রন্থগুলো হলো, সমকালীন জীবনবোধ, স্মৃতির সৈকতে আমি, ইসলামের স্বর্ণযুগের ছিন্নপৃষ্ঠা, শেষ প্রেরিত নবী, সত্যার্থে ভ্রমণে, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রভৃতি। ইতিহাসের কিংবদন্তি এই মহাপুরুষ ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে তার গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ (রহ.) কে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার-২০০০ (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এছাড়া তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের আনাচে-কানাচে তার নামে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

লেখক : কবি ও গবেষক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত