শায়েস্তা খাঁর সাত গম্বুজ মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মোঘল স্থাপত্যের সুনাম-সুখ্যাতি বিশ্বজুড়ে। তাদের হাতে নির্মিত অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী দেখে বিমোহিত হয় প্রতিটি দর্শক হৃদয়। আগ্রার তাজমহল থেকে শুরু করে মোঘলদের এমন কোনো স্থাপত্য নেই, যেখানে পর্যটকরা ভিড় করে না। ভ্রমণপিপাসুরা স্থাপত্যের অপূর্ব নান্দনিকতায় বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। মুঘলদের হাতে নির্মিত এমনই একটি স্থাপত্য হলো ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’।

মসজিদের সামনের অংশটা সবুজে ছাওয়া। সামনের ফুল বাগানে বাহারি রঙের ফুল সৌন্দর্য বিলায় সারাক্ষণ। ডানপাশে একটি কবরস্থান। দেখতে অনেকটা লালবাগ কেল্লা মসজিদ এবং খাজা আম্বর মসজিদের মতোই। মসজিদের আঙিনাটা বেশ সুন্দর। পশ্চিম পাশে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া। যা ১৯৮৬ সালে শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতিহাসে খোঁজে : ষোড়শ শতাব্দের অনুপম নিদর্শন এই সাত গম্বুজ মসজিদ। সময়টা ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ। বাংলার নবাব তখন শায়েস্তা খাঁ। তার জ্যেষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ) খাঁ লাল পোড়ামাটির আবরণে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদের সঙ্গে লাগোয়া চারপাশে মিনারার মতো মোটা চারটা পিলার রয়েছে।

এই চার মিনারের ওপরের চারটা গম্বুজ আর মসজিদের ওপরের তিন গম্বুজ মিলে হয় সাত গম্বুজ। এ থেকেই এর নামকরণ হয়েছে ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’। সামনের দিকে তিনটি বিশাল প্রবেশদ্বার। মসজিদের গায়ে অন্যান্য মোঘল স্থাপত্যের মতো তেমন কারুকার্য নেই। সাদামাটা দেওয়ালে ছোট ছোট খোপ। সামনের দেওয়ালে তিনটি মেহরাব। রয়েছে একটি মিম্বর। মসজিদের দেওয়াল এতটাই পুরু যে, মেহরাবের জায়গাটা দেওয়ালের ভেতরেই নির্মাণ করা হয়েছে। বাইরের দিক থেকে বোঝার উপায় নেই এখানে কোনো মেহরাব আছে।

মসজিদের ভেতর : পূর্বদিকের দেওয়ালে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান দেখতে বেশ চমৎকার। মসজিদের আয়তাকার নামাজ কোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। মসজিদের ভেতরে ৪টি কাতারে প্রায় ৯০ জনের নামাজ পড়ার মতো স্থান রয়েছে। তবে প্রশস্ত চত্বরে কয়েকশ’ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

নৌকা ও ঘোড়ায় আসতেন মুসল্লিরা : ইতিহাস থেকে জানা যায়, এক সময় মসজিদের পাশ ঘেঁষে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গা নদী। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা। বর্ষায় পুরান ঢাকা থেকে মানুষজন নৌকা ও বজরায় আর শুকনো মৌসুমে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে মসজিদে নামাজ পড়তে আসতেন। ১৮১৪ সালে স্যার চার্লস ডি ওয়াইলির (ঢাকায় অবস্থানকাল ১৮০৮-১৮১১) আঁকা একটি চিত্রকর্ম আছে এই সাত মসজিদকে ঘিরে। তার শিরোনামে দেওয়া আছে ‘গঙ্গার শাখা নদী বুড়িগঙ্গার তীরে সাত মসজিদ’। এতে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর পাশেই মসজিদটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর নদীর বুকে বয়ে চলেছে অসংখ্যা নৌকা। বর্তমানে মসজিদের আগের সেই চিত্র খুব একটা চোখে পড়ে না। দালানকোঠায় ভরে উঠেছে মসজিদের চারপাশ। অথচ এক সময় দূর থেকে এই মসজিদকে দেখে মনে হতো তাজমহল।

তিন শতাব্দী পেরিয়ে : তিন শতাব্দীর বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও মসজিদটির অবকাঠামো এখনও প্রায় অবিকৃতই আছে। ১৯৮৮ সালের বন্যায় মসজিদে পানি উঠে গিয়েছিল। সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়েছিল। পরে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর এর দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তারা মসজিদের সামনের অংশটি পাকা করে মসজিদের ভেতরের অংশে এবং বাইরে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের স্থানটি মোজাইক করে দেয়। সমাধিটিও সংস্কার করা হয়।মসজিদটির নির্মাণ কৌশলে স্থপতির সৌন্দর্যবোধ ও প্রতিভা প্রশংসা করার মতো। সময়ের করালগ্রাস, আগাছা, ঝড়-বাদল ও রৌদ্রতাপ শুধু যে এর বর্ণবৈচিত্র্য বাড়িয়েছে শুধু তা নয়; সেইসঙ্গে বর্ণের উজ্জ্বলতায় কমনীয়তাও এনেছে। তারপরও মসজিদটি যুগ যুগ ধরে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখেছে এবং ইতিহাসপ্রেমী দর্শনার্থীদের বিস্মিত করছে।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া শরইয়্যাহ পাগাড়, টঙ্গী