৪০০ বছরের পুরোনো আতিয়া মসজিদ
মোস্তফা কামাল গাজী
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আতিয়া মসজিদ- বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলায় এর অবস্থান। ষোড়শ শতাব্দ থেকে নিয়মিত নামাজ হচ্ছে এখানে। আশপাশটা বেশ নিরিবিলি। তরুবীথিকায় ছাওয়া চারপাশ। হাজারো পাখির কলরবে মুখরিত পরিবেশ। ৪০০ বছরের কম হয়নি এর বয়স। মোঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এর পুরো দালান। দেয়ালের গায়ে অপূর্ব অলঙ্কারের ছাপ। মনে হয় যেন দক্ষ কারিগরের নিপুণ হাতের ছোঁয়া পড়েছে এতে। পুরোনো ১০ টাকার নোটে এই মসজিদের ছবি রয়েছে। তবে আজকাল ১০ টাকার পুরাতন নোটটি তেমন দেখা যায় না।
‘আতিয়া’ শব্দটি আরবি ‘আতা’ শব্দ থেকে উৎসারিত। এর অর্থ হলো ‘দান’। পঞ্চদশ শতকে এ অঞ্চলে আদম শাহ বাবা কাশ্মীরি নামে বিখ্যাত একজন ধর্মপ্রচারক আগমন করেন। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এখানে বসতি স্থাপন করে ইসলাম প্রচার করেন। এই পুণ্যবান ব্যক্তির কবরও এখানে অবস্থিত। তিনি বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হুসায়েন শাহ কর্তৃক আতিয়ার জায়গিরদার নিযুক্ত হোন। সে সময় ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহনের জন্য কররানি শাসক সোলাইমান কররানির কাছ থেকে বিশাল একটি এলাকা ‘ওয়াকফ’ হিসেবে পান। পরবর্তীতে এ দান বা ‘আতা’ থেকে এ পরগণার নাম ‘আতিয়া’ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
শাহ কাশ্মীরির শেষ বয়সে তার পরামর্শে সাঈদ খান পন্নীকে মোগল বাদশাহ জাহাঙ্গীর আতিয়া পরগণার শাসন কর্তা নিয়োগ করেন। সাঈদ খান পন্নীই করটিয়ার বিখ্যাত জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে আতিয়া মসজিদ নির্মাণ করেন।
এটি দেলদুয়ার উপজেলা তথা টাঙ্গাইল জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্য শিল্পরীতির সমন্বয়ে নির্মিত এ মসজিদের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন প্রখ্যাত স্থপতি মুহাম্মদ খাঁ। মসজিদটি নির্মাণের পর ১৮৩৭ সালে রওশন খাতুন চৌধুরী ও ১৯০৯ সালে আবুল আহমেদ খান গজনবি সংস্কার করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন সূত্র অনুযায়ী, মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪২ ফুট, প্রস্থ ৩২ ফুট এবং উচ্চতা ৪৪ ফুট। একটি বড় আকৃতির গম্বুজসহ মোট চারটি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের দেয়াল আট থেকে সারে আট ফুট প্রশস্ত। মসজিদটির কিবলাকোটা ও বারান্দাসহ সার্বিক পরিমাণ ১২ মিটার। মসজিদের দেয়াল ২.২২ মিটার প্রশস্ত। বারান্দা ৩.৮২ ৭.৫ মিটার। সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্যরীতির সুষম সমন্বয় এ মসজিদে দেখা যায়। চারকোণে ৪টি বিরাট অষ্টকোণা আকৃতির মিনার রয়েছে। মিনারগুলো ছাদের অনেক উপরে উঠে ছোট গম্বুজে শেষ হয়েছে।
বাংলার স্থাপত্য-কীর্তিগুলো মূলত ইটের তৈরি। তাই বাংলার স্থাপত্য এবং তার অলংকরণ সবই বিকশিত হয়েছে ইটের মাধ্যমেই। আতিয়া মসজিদও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এ মসজিদে সুলতানি স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্য রয়েছে দারুণভাবে। বক্রাকার কার্নিশ, দ্বিকেন্দ্রিক সুচালো খিলান এবং গম্বুজ নির্মাণে বাংলা পান্দান্তিভ ব্যবহার এবং পোড়ামাটির টেরাকোটা নকশা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। মানুষের হাতের কারুকার্য কতটা নিখুঁত আর সুন্দর হতে পারে, এই মসজিদটিই তার উৎকৃষ্ট উদাহারণ। অসংখ্য নকশাখচিত মসজিদটির গায়ে খোদাই করা হয়েছে আরবি হরফ।
মসজিদের বারান্দার ওপর ছোট তিনটি গম্বুজ বাংলা পান্দান্তিভ পদ্ধতিতে নির্মিত। পরবর্তীতে সংস্কারের সময় গম্বুজগুলো পলেস্তরা দিয়ে সমান করে দেওয়া হয়েছে। যদিও মসজিদ নির্মাণের সময় এমনটা ছিল না। আদিতে গম্বুজগুলো পলকাটা বা ঢেউতোলা ছিল।
টাঙ্গাইল অঞ্চলে প্রাপ্ত শিলালিপিগুলোর মধ্যে আতিয়া জামে মসজিদের একটি আরবি আরেকটি ফারসি শিলালিপি রয়েছে। এসবের মাধ্যমে মসজিদের প্রকৃত নির্মাতা ও সময়কাল সম্পর্কে জানা যায়। বিদায়ী সুলতানি আর নবাগত মোগল উভয় রীতির সংমিশ্রণে অপূর্ব এক মুসলিম স্থাপত্য, যা দৃষ্টিনন্দন এবং এ অঞ্চলে বিরল।
মসজিদের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন আহাম্মেদ জানান, ২০০১ সালের পর থেকে মসজিদটিতে কোনো চুনকাম করা হয়নি। বিভিন্ন অংশে শ্যাওলা জমে কালো হয়ে গেছে। দেয়ালের কিছু ইট-বালিও খসে পড়ছে। মসজিদটির প্রধান গম্বুজের একটি অংশ ভেঙে পড়ায় বৃষ্টি হলে মসজিদে পানি পড়ে। বিশেষত বর্ষাকালে মুসল্লিদের নামাজ আদায়ে দুর্ভোগে পড়তে হয়।
