হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের অবদান
রায়হান রাশেদ
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। মানুষের শরীর, মন ও মানসিকতার সঙ্গে চিকিৎসার সম্পর্ক। প্রয়োজনে মানুষকে চিকিৎসাপদ্ধতির দ্বারস্থ হতে হয়। অসুস্থ ব্যক্তির রোগের ধরন আবিষ্কার করে নিয়ামক বা পথ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হয়। আদিম যুগে মানুষ যখন অসুস্থ হলে তারা বিভিন্ন পদ্ধতিতে সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করেছে। রোগীর বাড়তি সেবা-যত্ন নিয়েছে। ঘরোয়া পরিবেশে সেবা দিয়েছে। বর্তমান সময়ের মতো তদানিন্তন পৃথিবীতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়নি। ঘরই ছিল মানুষের হাসপাতাল। সেই আমলে রোগীর জন্য কেউ আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করত। রোগীর অবস্থা জটিল-কঠিন হলে ধর্মীয় মনীষীর শিবির বা আশ্রমে ধরনা দিত। কখনও রোগীকে সেখানে রাখা হতো। গ্রিক, রোমান ও মিসরীয় সভ্যতায় চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছুটা উন্নতি হয়। তবে চিকিৎসা শাস্ত্রের পরিপূর্ণ যৌবন রচিত হয় মধ্যযুগে মুসলমান শাসক ও বিজ্ঞানীদের কল্যাণে।
Hospital শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ Hospes থেকে। যার অর্থ Host – নিয়ন্ত্রণকর্তা। Hospital মানে চিকিৎসাগার। মধ্যযুগে আজকের হাসপাতালকে বলা হতো ‘বিমারিস্তান’। এটি ফার্সি ভাষার শব্দ। এর অর্থ রোগীর স্থান।
চিকিৎসা শাস্ত্রে ইবনে সিনা, আল-বেরুনি, আত-তাবারি, আর-রাজি, ইবনে রুশদ, আলি আল মাওসুলি প্রমুখের নাম ইতিহাসের পাতায় বিমুগ্ধ খুশবু ছড়াচ্ছে। তারা চিকিৎসাশাস্ত্রের কীর্তিমান মহাপুরুষ। তাদের হাতেই চিকিৎসা শাস্ত্রের সূচনা ও জয় হয়েছে। আর তারা চিকিৎসাশাস্ত্রের কনসেপ্ট ও অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছে আল কোরআন ও হাদিস থেকে। মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন তাদের আইডল। মহানবী (সা.)-এর যুগে অসুস্থদের সেবা-শুশ্রƒষা করা হতো দুইভাবে। মহানবী (সা.) যুদ্ধে আহত সাহাবিদের জন্য যুদ্ধের ময়দানের অনতিদূরে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যোপযোগী স্থানে তাঁবু স্থাপনের নির্দেশ দিতেন। তাঁবু ছিল আহত অসুস্থ সাহাবিদের অস্থায়ী হাসপাতাল।
খন্দকের যুদ্ধের সময় মুসলমানরা চিকিৎসাসেবার জন্য স্বতন্ত্র তাঁবু স্থাপন করে। সাদ ইবনে মুআজ (রা.) যখন যুদ্ধে আহত হন, রাসুল (সা.) তাকে এই স্বতন্ত্র তাঁবুতে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেসব তাঁবুতে আহতদের সেবার জন্য নিযুক্ত থাকত নারীরা। আজকের পৃথিবীর ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও চিকিৎসার ধারণাটি এখান থেকেই মানুষ নিয়েছে।
পরবর্তী খলিফা ও শাসকদের আমলেও ভ্রাম্যমাণ এ চিকিৎসা চালু থাকে। উমাইফা খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান (৬৪৬-৭০৫) বিপুল অর্থ ব্যয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এক বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। তখনকার সময়ের প্রতিথযশা বিজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। রোগীর শ্রেণি বিন্যাস অনুযায়ী পৃথক প্রথক বিভাগ ছিল। প্রতিটি বিভাগের জন্য ছিল ওই বিষয়ের পারদর্শী চিকিৎসক। তারা সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা দিত। রোগীর বাড়তি সেবার জন্য ছিল নার্স। পুরুষ ও নারীর জন্য ছিল আলাদা কক্ষ। পরিবেশ ছিল সুখকর ও আনন্দদায়ক। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ছিল নানা রঙের ফুল ও ফলের বৃক্ষ।
আল ওয়ালিদ ইবনে মালিক (৬৬৮-৭১৫) খলিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের সন্তান। ৭০৫ থেকে ৭১৫ সাল পর্যন্ত খলিফার পদে আসীন ছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানসিক হাসপাতাল নির্মাণ করেন তিনি। তারপর থেকে মানসিক রোগ চিকিৎসায় বিজ্ঞানীরা উন্নতি সাধন আরম্ভ করে। কুষ্ঠব্যাধির জন্য বিখ্যাত ছিল হাসপাতালটি। ডাক্তারদের মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা নির্ধারণ ছিল এখানে।
আব্বাসিয় খলিফা হারুন-অর-রশিদ (৭৬৬-৮০৯) ৮০৫ হিজরীতে ইরাকের বাগদাদে সাধারণ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যে তৎকালিন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ৩০টির অধিক এমন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি বাগদাদের বিখ্যাত গ্রন্থাগার বাইতুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠা করেন।
৮৭২ সালে আহমদ ইবনে তুলুন মিশরের কায়রোতে প্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতালের নাম আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল।
নবম শতকে তিউনিসিয়ায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগের এ সময়ে মুসলমানদের তৈরি সবচে ভালো বিস্তৃত বিন্যাসের ও পরিবেশবান্ধব হাসপাতাল শাসক ওদুদ আল ওয়ালিদ ৯৮২ সালে বাগদাদে নির্মাণ করেন। হাসপাতালে চিকিৎসক ছিলেন ২৫ জন। বিশেষজ্ঞ ছিলেন অনেকে।
দশম শতকে কারাগারের কয়েদিদের সুস্বাস্থ্য ও চিকিৎসার জন্য জেলের ভেতর মিনি হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। হাসপাতালের নিয়োগপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা প্রতিদিনই বন্দিদের পরীক্ষা করতেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান করতেন।
দ্বাদশ শতকে কায়রোতে ‘নাসিরি’ এবং ‘মানসুরি’ নামে দুটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সময়ে ইরানের রাইত শহরে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন জগতের অন্যতম মনীষী বিজ্ঞানী আল-রাজি।
ইসলামি শাসনামলে বাগদাদ, কর্ডোবা, দামেস্ক, কায়রোর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শহরে অনেক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়। শুধু স্পেনের কর্ডোবা শহরেই ছিল ৫০ টির বেশি হাসপাতাল। তার মধ্যে কোনো হাসপাতাল ছিল সামরিক বাহিনীর জন্য নির্দিষ্ট। বর্তমান বিশ্বের সামরিক বাহিনীর জন্য প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের ধারণাটি মুসলমানদের। প্রখ্যাত ড. ডানল্ড ক্যম্বল লিখেছেন- একমাত্র কর্ডোবায় ইসলামী শাসনামলে প্রায় ৫০০ চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল। ‘আল জেকিরাজ’ ছিল অন্যতম। সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত রাজ চিকিৎসকরা এটি পরিদর্শন করতেন। কার্যনির্বাহী পদ শুধু মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, অভিজ্ঞ, কৌশলী, পরিশ্রমী অনেক ইহুদি, খিষ্ট্রান যুক্ত ছিল।
মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষেও অনেক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এ সব হাসপাতালয়ে সব ধরণের চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধ-পথ্য মজুত থাকত। অন্যান্য চিকিৎসা বিভাগের সঙ্গে অস্ত্রোপচারের আলাদা বিভাগ ছিল। শরীরের বিভিন্ন স্থানে অস্ত্রোপচারের জন্য ছিল আলাদা সার্জন। সুলতান নুরুদ্দিন মুহাম্মদ জংগি (মৃত্যু ১১৭৪) ছিলেন মুসলিম শাসকদের মধ্যে কীর্তিমান। তিনি দামেস্ক নগরীতে এক বিশাল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা ছিল সেখানে। যুগ শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরা চিকিৎসা কর্মে নিযুক্ত ছিলেন। হাসপাতালের উন্নয়নে বিপুল অর্থ তিনি ব্যয় করেন। হাসপাতাল সংলগ্ন জমিনে তিনি বিশাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিপুল বই ছিল সেখানে। সমৃদ্ধ ও বিরাট সে লাইব্রেরি এখনও আছে। ইতিহাসের অনেক পর্যটকদের লেখায় নুরী হাসপাতাল ও তার লাইব্রেরির কথা ফুটে ওঠেছে। হাসপাতালের নাম রাখেন তার নিজের নামেই। হাসপাতালের প্রধান মুখ্য চিকিৎসক ছিলেন আবুল হিকাম ওরফে ইবনুদ দাখওয়ার। ইবনু আবি উসাইবা, ইবনু নাফিস ছিলেন তাঁর সহকারী। তারা ব্যক্তিগতভাবে রোগীদের খোঁজখবর নিতেন। হাসপাতালে একজন প্রধান চিকিৎসক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করতেন। প্রতিদিন রোগীদের ভিজিট করতেন। কে বাড়ি যেতে পারবে- এ ব্যাপারে তিনি আদেশ লিখতেন। তারা যখন রোগী দেখতে যেতেন, তখন তাদের পেছনে থাকত নার্স বা সেবকদের কাফেলা।
ভারতে মুসলিম শাসকদের মধ্যে ফিরোজ শাহ তুঘলক (শাসনামল-৭৫২ হিজরি) একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এই হাসপাতালকে তখন ‘সিহহত খানা’ বলা হতো। সুলতান হাসপাতালে কয়েকজন চিকিৎসক নিয়োগ দেন। হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগীদের খাবার সরবরাহ করা হতো। সুলতান বেশকিছু জমি হাসপাতালের ব্যয় বহনের জন্য হাসপাতালের নামে ওয়াকফ করে দেন। তারিখে ফিরোজশাহিতে শুধু একটি হাসপাতালের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু ঐতিহাসিক আবুল কাসেম ফেরেশতা লিখেছেন, সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক মোট পাঁচটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন।
আহমেদাবাদে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন সুলতান আলাউদ্দিন বিন সুলতান আহমদ শাহ বাহামানি (মৃত্যু ৭৫৭ হিজরি)। এই হাসপাতালের ব্যয়ের জন্যও সুলতানের ওয়াকফ করা জমি ছিল। ৮৪৯ হিজরীতে মালোয়ার শাসক মাহমুদ খিলজি শাদিআবাদে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। হেকিম মাওলানা ফজলুল্লাহকে পাগলদের চিকিৎসা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
মুঘল বাদশাহদের মধ্যে জাহাঙ্গীর সর্বপ্রথম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হন। গুরুত্বের সঙ্গে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। সেকালের একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক হেকিম আলি প্রতি বছর দরিদ্রদের মধ্যে প্রায় ৬ হাজার ওষুধ বিলি করতেন। মুঘল সম্রাট আকবরও অনেক সরাইখানা নির্মাণ করেন। সেখানে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল কোথাও কোথাও। তার অধীনে মন্ত্রীবর্গ, বিভিন্ন আমলারও সরাইখানা তৈরি করেন।
এভাবে ইসলামি শাসনামলে মুসলমানরা বিভিন্ন শহর গ্রামে মানুষের চিকিৎসা প্রদানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। হাসপাতাল কাজ সম্প্রসারণ করেন। রোগীদের প্রতি যথার্থ সেবা ও মূল্যায়নের দিকে অধিক গুরুত্ব ছিল। আন্তরিকতা ছিল চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠাতার প্রধানতম ধর্ম। মানুষের সেবায় ছিল তাদের ব্রত। প্রাতিষ্ঠানিক হাসপাতাল ছাড়াও মুসলমানরা ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে মানুষের চিকিৎসা দিতেন। মানুষকে ভালোবেসে মানুষের জন্য কাজ করেছেন মুসলিম মনীষীরা। মুসলিম মনীষীরা সেসব সেবাধর্মী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, আধুনিক-উত্তর পৃথিবীতে আজ তার বড় অভাব। তাদের মতো নিবেদিতপ্রাণের হাসপাতাল আজ আর মানুষের চোখে পড়ে না।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক
