নববি চিকিৎসা হিজামার উপকারিতা
আবদুল্লাহ নুর
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে হিজামা ছিল অন্যতম চিকিৎসাব্যবস্থা। আদিকাল থেকেই আরব বিশ্বসহ মধ্যপ্রাচ্যে এটি বেশ জনপ্রিয়। আঠারো শতকের দিকে ভারত উপমহাদেশসহ পৃথিবীর পূর্বাঞ্চলের মানুষও হিজামা ব্যবহার শুরু করে।
হিজামা আরবি আল-হাজম শব্দমূল থেকে নির্গত, যার অর্থ রক্তমোক্ষণ যন্ত্র। তবে আমাদের দেশে লোকে জানে শিংগা নামে। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজামা চিকিৎসার ব্যাপারে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘রোগমুক্তি তিনটি জিনিসের মধ্যে নিহিত- হিজামা লাগানো, মধু পান করা এবং আগুন দিয়ে গরম দাগ দেওয়া। তবে আমি আমার উম্মতকে আগুন দিয়ে গরম দাগ দিতে নিষেধ করি।’ (বোখারি : ৫৬৮১)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মিরাজের রাতে আমি যে দলকেই অতিক্রম করেছি, তারা আমাকে বলেছেন, হে মুহাম্মাদ, হে মুহাম্মাদ, আমার উম্মতকে হিজামার নির্দেশ দিন।’ (তিরমিজি : ২০৫২)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাইল (আ.) আমাকে জানিয়েছেন যে, মানুষ চিকিৎসার জন্য যত সব উপায় অবলম্বন করে, এর মধ্যে হিজামাই হলো সর্বোত্তম।’ (মুসতাদরাকে হাকিম : ৭৪৭০)।
হিজামার উপকারিতা : ব্যাক পেইন, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁটুর ব্যথা, মাথাব্যথা (মাইগ্রেন), ঘাড়ে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, বাত, ঘুমের ব্যাঘাত, জ্ঞান এবং স্মৃতিশক্তিহীনতা, ত্বকের বর্জ্য পরিষ্কার, অর্শ্ব, পাঁচড়া, ফোঁড়াসহ ইত্যাদি রোগ থেকে হিজামা চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করা যায়, যা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস থেকে স্বীকৃত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই হিজামায় নিরাময় আছে।’ (বোখারি : ৫৬৯৭)।
মাথাব্যথা : সালমা (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘যখন কেউ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে মাথাব্যথার কথা বলত, তখন তিনি তাদের হিজামা করার কথা বলতেন।’ (আবু দাউদ : ৩৮৫৮)।
জ্ঞান ও স্মৃতিবর্ধক : ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘খালি পেটে হিজামা লাগানো উত্তম। এতে শিফা ও বরকত রয়েছে। এতে জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৪৮৭)।
হাঁটুর ব্যথা : আনাস বিন মালেক (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যথার কারণে ইহরাম অবস্থায় তার পায়ের উপরিভাগে (হাঁটু) হিজামা করিয়েছেন।’ (আবু দাউদ : ১৮৩৭)।
বিবিধ রোগ : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঊরুতে ব্যথা, চুলকানি ও খোসপাঁচড়ার চিকিৎসা হিসেবে বুকের নিচে হিজামা লাগানো উপকারী। এতে পিঠের গেঁটেবাত, অর্শ্ব, গোদ রোগ, খোসপাঁচড়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।’ (জাদুল মাআদ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৫৮)।
হিজামার অঙ্গগুলো : হিজামা ব্যবহারে বিশেষ কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। দেহের প্রত্যেক অঙ্গে-প্রত্যঙ্গে ইচ্ছেমতো হিজামা করা যাবে না। বিশেষ বিশেষ অঙ্গে ব্যবহারের অনুমতি বা নিয়ম রয়েছে।
মাথার তালু ও কাঁধের মাঝে : আবু কাবশাহ (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মাথার মাঝখানে এবং দুই কাঁধের মাঝে হিজামা করতেন এবং বলতেন, যে ব্যক্তি নিজ শরীরের এ অংশে হিজামা করাবে, সে তার কোনো রোগের চিকিৎসা না করালেও কোনো ক্ষতি হবে না।’ (আবু দাউদ : ৩৮৫৯)।
বুকের নিচে : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ঊরুতে ব্যথা, চুলকানি ও খোসপাঁচড়ার চিকিৎসা হিসেবে বুকের নিচে হিজামা লাগানো উপকারী। এতে পিঠের গেঁটেবাত, অর্শ্ব, গোদ রোগ, খোসপাঁচড়া প্রতিরোধে সাহায্য করে।’ (জাদুল মাআদ : ৪/৫৮)
থুতনির নিচে : ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, ‘দাঁতে, মুখে ও গলায় ব্যথা হলে থুতনির নিচে হিজামা লাগালে উপকার পাওয়া যায়, যদি তা সঠিক সময়ে করা হয়। এটা মাথা ও চোয়াল শোধন করে।’
হিজামা লাগানোর উত্তম সময় : অসুস্থ বা ব্যথা হলে সুবিধামতো হিজামা লাগানো যেতে পারে। তবে হিজামার উত্তম সময় হচ্ছে চন্দ্র মাসের ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখ। আনাস বিন মালেক (রা.) বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘাড়ের দুই পাশের শিরায় এবং ঘাড়ের কাছাকাছি পিঠের ফোলা অংশে হিজামা করাতেন। তিনি মাসের ১৭, ১৯ ও ২১ তারিখে হিজামা করাতেন।’ (তিরমিজি : ২০৫১, ২০৫৩)।
অন্য আরেকটি হাদিস থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃহস্পতি, সোম ও মঙ্গলবার হিজামা লাগানোর জন্য উৎসাহিত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর বরকত লাভের আশায় তোমরা বৃহস্পতিবার হিজামা করাও এবং বুধ, শুক্র, শনি ও রবিবার বেছে নেওয়া থেকে বিরত থাকো। আর সোম ও মঙ্গলবারে হিজামা করাও।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৪৮৭)।
খালি পেটে হিজামা করানো উত্তম। এতে নিরাময় লাভ হয় এবং বরকত পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘খালি পেটে হিজামা করালে নিরাময় ও বরকত লাভ হয় এবং তাতে জ্ঞান ও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।’ অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাসের যেকোনো বিজোড় তারিখের প্রতি লক্ষ রেখে হিজামা লাগনো ভালো। তবে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা বা অতি প্রয়োজনে যে কেউ যেকোনো সময় বা বারে হিজামা নিতে পারবে। (আত-তিব্বুল বাদিল, পৃষ্ঠা : ২২৮)।
লেখক : আলেম ও মাদরাসা শিক্ষক
