বড় সোনা মসজিদ
মোস্তফা কামাল গাজী
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলার পুরোনো রাজধানী পশ্চিমবঙ্গের গৌড়ে মুসলিম ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শনগুলোর অন্যতম বড় সোনা মসজিদ। কালের সাক্ষী হয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা স্থাপত্যটি গৌড়ের পুরোনো স্থাপত্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে আলাউদ্দিন হোসেন শাহর স্থাপত্য রীতিতে। মসজিদে প্রবেশ করতে হলে বিশালাকৃতির গেটের আশ্রয় নিতে হয়। গেটটা পুরোনো ধাঁচে নির্মিত। তাজমহল ও আগ্রা ফোর্টের গেটের মতো বিশাল গেটটিতে রয়েছে অপূর্ব কারুকার্যের ছাপ। দেয়াল খোদাই করে আঁকা হয়েছে সুন্দর শিল্পকর্ম। গেটের কিছু অংশ ধসে পড়েছে এর মধ্যে। সংস্কার না করায় আস্তে আস্তে খসে পড়েছে আস্তরণ। গেটের আশপাশে কোনো সীমানা প্রাচীর নেই। খালি প্রান্তরে শুধু গেটটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে যায় সবুজের সমারোহ দেখে।
গেট বরাবর সামনেই বড় সোনা মসজিদ। মসজিদের আশপাশের দুর্বা ঘাসের কারণে সবুজে ছেয়ে আছে পুরো এলাকা। মনে হয় যেন নৈসর্গিক নিকুঞ্জ। যত্ন করে ছোট্ট রাস্তার দুপাশে লাগানো হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট গাছের সারি। গড়ে তোলা হয়েছে অপরূপ ফুলের বাগান। নাম না জানা শত শত ফুল ফুটে আছে সেখানে। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি আর মৌমাছির ঝাঁক। হাজারো পাখির কলকাকলিতে মুখর থাকে বেলা-অবেলার প্রহর। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
মসজিদটি এখন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। একসময় এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হলেও এখন বিরাণ পড়ে আছে। দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে লতাগুল্ম। মাজিদের ভেতরের ফ্লোরে গজিয়ে উঠেছে সবুজ গাছ। ভেঙে পড়েছে দেয়াল। মসজিদের গম্বুজগুলোর ওপর সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল বলে মসজিদের নাম হয় সোনা মসজিদ। গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুর গ্রামে সোনালি রঙের আস্তরণযুক্ত আরেকটি সোনা মসজিদ ছিল। সেটি ছিল আকারে ছোট। তাই এ মসজিদটিকে বলা হতো বড় সোনা মসজিদ, আর ফিরোজপুরেরটিকে বলা হতো ছোট সোনা মসজিদ। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে মসজিদটি ‘বারোদুয়ারি’ বা ‘বারো দরজাবিশিষ্ট’ বলে পরিচিত। কিন্তু বাস্তবে মসজিদের সামনের দিকে এগারটি দরজা রয়েছে। তাই অনেকে মনে করেন, ‘বারদুয়ারি’ দ্বারা উদ্দেশ হলো, ‘শ্রোতাদের মিলনায়তন’। মসজিদের সামনের ভাগের বিস্তৃত অঙ্গনই মসজিদের এ নামকরণের কারণ।
মসজিদের দেয়াল ইটের গাঁথুনির ওপর পাথরের আস্তরণে নির্মিত। চার কোণে অষ্টভুজ বুরুজসহ আয়তাকার এ মসজিদের দৈর্ঘ্য ৫১.২ মিটার এবং প্রস্থ ২৩.১৫ মিটার। মসজিদের সম্মুখভাগে রয়েছে উত্তর-দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত বারান্দা। সেখানে নির্মিত হয়েছে ১১টি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি করে প্রবেশপথ। মসজিদটি তিন কাতারবিশিষ্ট। আয়তাকার পুরু স্তম্ভের ওপর স্থাপিত পেন্ডেন্টিভের ওপর বসানো আছে মোট ৪৪টি গম্বুজ। বর্তমানে শুধু বারান্দার ওপরের গম্বুজগুলো এবং মসজিদের দেয়ালের ওপরের গম্বুজগুলো টিকে আছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে এক সময় একটি রাজকীয় গ্যালারি ছিল। ওপরে ছিল চারটি গম্বুজ। অন্যান্য মসজিদের মতো গ্যালারির প্রবেশপথগুলো ছিল বাইরের দিকে। মসজিদের ১১টি প্রবেশপথ বরাবর নির্মিত হয়েছে এগারোটি মিহরাব। কালের আবর্তে সবই এখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত।
মসজিদের পূর্ব ও উত্তর দিকের দুটো দরোজা এখনও অবশিষ্ট আছে। মাঝখান বরাবর খিলানপথ বিশিষ্ট দরোজা দুটো একই ধরনের। মসজিদটি পাথর দ্বারা নির্মিত চতুষ্কোণ স্তম্ভ দ্বারা উত্তর-দক্ষিণে তিনটি আইলে ও পূর্ব-পশ্চিমে এগারটি সারিতে বিভক্ত। তিনটি আইলের উভয় দিকে তিনটি করে দরজা আছে। একেবারে উত্তর দিকের তিনটি সারির ওপর জেনানা মহল অবস্থিত। এতে চড়ার জন্য উত্তর দিকে সিঁড়িও আছে।
মসজিদটি কে নির্মাণ করেছেন এবং এর নির্মাণের সময়ই বা কখন সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনাকর্মকর্তা মেজর ফ্রাঙ্কলিন মসজিদটির কাছে একটি শিলালিপি আবিষ্কার করেন। তখন এটিকে এই মসজিদেরই শিলালিপি বলে মনে করা হয়েছিল। শিলালিপিতে ৯৩২ হিজরি (১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দ) লেখা থাকায় অনুমান করা হয় সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহ মসজিদটি নির্মাণ করেন। কিন্তু পরে মসজিদের ঠিক বাইরে উত্তর-পশ্চিম কোণে আরো একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। এতে ৯৩০ হিজরিতে (১৫২৩ খ্রি.) নুসরত শাহ কর্তৃক শুধু একটি প্রবেশদ্বার নির্মাণের কথা উল্লেখ রয়েছে। এটি পাওয়ার পর আগের ধারণাটি ভুল বলে মনে করা হয়। মালদহের রাষ্ট্রীয় জাদুঘরে শিলালিপিটি সংরতি আছে। এই শিলালিপিতে উল্লেখ করা তারিখ ফ্রাঙ্কলিনের শিলালিপির সময়ের দুই-তিন বছর আগের। কিন্তু মসজিদ নির্মাণের আগেই তার প্রবেশপথ নির্মিত হয়েছিল এ কথা যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং প্রচলিত রীতি হচ্ছে, মূল ভবন নির্মাণের পরেই তার প্রবেশপথ নির্মিত হয়। এজন্য এই শিলালিপিটি মসজিদের না বলে ধরে নেয়া যায়। তা ছাড়া নুসরত শাহ নির্মিত বাঘা মসজিদের স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে এর যথেষ্ট অমিল রয়েছে। বাঘা মসজিদে ইসলামি রীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সব অংশেই পোড়ামাটির ফলকের অলঙ্করণ রয়েছে। কিন্তু বড় সোনা মসজিদটি সাদামাটা ও প্রায় অলঙ্করণবর্জিত। তবে মসজিদের মিহরাব অন্য সব মসজিদের মতোই ব্যাপকভাবে অলঙ্কৃত।
আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালের প্রথম দিকে তার কোনো বংশধরের বানানো ছোট সোনা মসজিদের সঙ্গে এই মসজিদের যথেষ্ট মিল রয়েছে। এ দুই মসজিদের সাদৃশ্য এবং শিলালিপিতে ১৫২৩ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখ থেকে ধারণা করা হয়, আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বের শেষ দিকে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তার রাজত্বের শেষদিকে রামকেলির কাছাকাছি মূল শহরের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে বুজুর্গ হুসাইনাবাদ নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। অসম্পূর্ণ এ নগর বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত। কিন্তু নগরের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ টিকে আছে এখনও। দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক প্রতিদিন ভিড় করে থাকেন পুরোনো আমলের ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি দেখার জন্য।
