ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের সূচনা যেভাবে
* পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে গত শতাব্দীর মধ্য ভাগ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম ধীরে ধীরে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে প্রসারিত হয়েছে। তবে এই স্তরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং স্থানীয় জীবনাচারে তার প্রভাব বিস্তার
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

ইন্দোনেশিয়া পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলকে ‘ইস্ট ইন্ডিজ’ বলা হয়। কিন্তু আমরা এটাকে আর্কিপিলাজো নামে অভিহিত করব, যা মালয়েশিয়া ও ফিলিপিন্সকে অন্তর্ভুক্ত করবে। মালয়েশিয়া থেকে নিউগিনি পর্যন্ত অঞ্চলটি পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের মতো পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত নয়।
ফলে মুসলিম বাহিনী এই অঞ্চলকে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে নিজেদের অধীন করেনি। এই অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটেছে আধ্যাত্মিকতা, বুদ্ধিবৃত্তি, ধর্মীয় সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মাধ্যমে।
ইসলামণ্ডপূর্ব যুগে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া অঞ্চলে হিন্দুদের রাজত্ব ছিল। তবে ধর্ম হিসেবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও প্রাণীপূজার চর্চা হতো। ইন্দোনেশিয়ায় ভারতীয় ধর্মের আগমন ঘটেছিল সম্রাট অশোকের আমলে, যিনি প্রথম জীবনে যুদ্ধের মাধ্যমে রাজত্বের বিস্তার ঘটান; কিন্তু কালিঙ্গার যুদ্ধের পর তিনি বৌদ্ধের অহিংস নীতি অবলম্বন করেন। তিনি পাথরের শিলায় অহিংসার বাণী লিপিবদ্ধ করে শ্রীলঙ্কা, বার্মা, আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঠান। ফলে ইন্দোনেশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের উত্থান ঘটে এবং কবি কালিদাসের প্রেরণায় সম্রাট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হিন্দু ধর্ম প্রচারে উদ্যোগ নেয়। সে সময় ইন্দোনেশিয়ায় হিন্দু ধর্মেরও প্রসার ঘটে।
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম প্রচারের ইতিহাসকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় : ক. ৬২২ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ, খ. ১১০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ এবং গ. ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত।
প্রথম ধাপটি ছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগের ফসল। ইসলাম আগমনের আগে থেকেই এশিয়ার পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের ভেতর যোগাযোগ ছিল। আরব বণিকরা শ্রীলঙ্কা, জাভা ও সুমাত্রা পর্যন্ত যাতায়াত করত। ইসলাম আগমনের ফলে এই যোগাযোগ আরও জোরালো হয়েছিল, বিশেষ করে আব্বাসীয় খলিফারা বাণিজ্য প্রসারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মুসলিম বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ইসলাম প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা এসব অঞ্চলে নিজস্ব বসতিও স্থাপন করেন। ঐতিহাসিক আল মাসুদি লিখেছেন, ৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে চীনের ক্যান্টনে দুই লাখ মুসলমানের একটি বসতি ছিল। ৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কৃষক বিদ্রোহের সময় এসব মুসলিম মালয় দ্বীপপুুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
আরব বণিকদের সততা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে বহুসংখ্যক মালয় মুসলমান হয়। সুমাত্রায় স্থানীয়দের সঙ্গে বিয়ে ইসলাম প্রসারে ভূমিকা রাখে। আরব মুসলিমরা স্থানীয়দের তাদের পোশাক ও সংস্কৃতি গ্রহণে বাধ্য করেনি, উল্টো তারা ইসলামের মৌলিকত্ব রক্ষা করে স্থানীয় সংস্কৃতিকে আপন করে নেয়। ফলে আরবরা একটি ছোট দল হলেও মালয় সমাজে সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করত। তারা কোরআনের ভাষায় কথা বলত, ধার্মিকতা ও সততায়ও ছিল তারা শ্রেষ্ঠ। এমনকি রাজা ও সুলতানরা আরব পরিবারে বিয়ে করতে পারাকে সম্মানের মনে করত। আরব পরিবারের শিশুদের নবীপরিবারের শিশুদের মতো সম্মান করা হতো। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে ইন্দোনেশিয়ায় ফিকহে মালেকি ও সুফিবাদের বিকাশ ঘটে।
খ্রিষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে ইমাম গাজালি (রহ.) ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও তাসাউফ শাস্ত্রে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আসে। এ সময় বিশ্বের নানা প্রান্তে তাসাউফ শাস্ত্রের উত্থান ঘটে। যার প্রভাব ইন্দোনেশিয়ায়ও পড়ে। সুফি সাধকদের হাত ধরেই একাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় ব্যাপকভাবে ইসলামের প্রসার ঘটে। খ্রিষ্টীয় একাদশ শতকে সুফি শায়খ আবদুল্লাহ আরিফ সুমাত্রায় আগমন করেন। তাঁর একজন শিষ্য শায়খ বাহাউদ্দিন শাহ উত্তর সুমাত্রায় ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে সুমাত্রার শাসক জোহান শাহ ইসলাম গ্রহণ করলে জনসাধারণের একটি বড় অংশ ইসলাম গ্রহণ করে। ১২৯৭ সালে সুলতান মালিক সালিহের আমলে সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে।
পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে গত শতাব্দীর মধ্য ভাগ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় ইসলাম ধীরে ধীরে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে প্রসারিত হয়েছে। তবে এই স্তরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন এবং স্থানীয় জীবনাচারে তার প্রভাব বিস্তার। এ সময় সুফি ও আলেমদের প্রভাবে মালয় ভাষায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটে। এতে নতুন বর্ণ যুক্ত করা হয় এবং প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ যুক্ত হয়। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে মালয় ভাষা অত্র অঞ্চলের প্রধান ভাষায় পরিণত হয় এবং জাভানিজ ভাষার স্থান দখল করে।
