ছোট সোনা মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী

প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে প্রায় ৫০০ বছর আগে নির্মিত হয়েছিল ছোট সোনা মসজিদ। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার অধীনে পড়েছে। মসজিদটিকে বলা হয় সুলতানি আমলের রত্ন। সুলতান আলাউদ্দিন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) মনসুর ওয়ালি মোহাম্মদ বিন আলি নামে এক ব্যক্তি এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন প্রামাণিক দলিল ও এ সংক্রান্ত প্রকাশিত গ্রন্থের তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে যা পাওয়া যায় তা হলো, মসজিদ প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে গোড়াতে একটি বহির্দেয়াল ছিল। যা এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সোনালি গম্বুজের কারণে মসজিদের নাম দেয়া হয়েছিল সোনা মসজিদ। সোনা দিয়ে গিল্ড করা গম্বুজগুলো বহুদুর থেকেও ঝকঝকে দেখাত বলে এমন নামকরণ। মসজিদের বাইরের দেয়ালেও সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল। সূর্যের আলো পড়লে এ রং সোনার মতো ঝলমল করত।

মসজিদের বাইরেরটা বেশ নিরিবিলি, শান্ত। পাখির কুজনে মুখরিত তরুবীথি। দুর্বাঘাসের সবুজ মাঠে বাঁধাই করা বেশ কয়েকটি কবর। মসজিদের মূল প্রাঙ্গণেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুই বীর সন্তানের সমাধি। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের কবর।

মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য রয়েছে মাঝারি আকৃতির গেট। সীমানা প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ শুধু বাকি আছে এখন। মসজিদের চারপাশে চকচকে টালির ব্লেসমেন্ট। ভেতর ও বাইরের দেয়ালে রয়েছে নকশা করা পাথরের টালি। এগুলো সোনা মসজিদকে বাড়তি স্বকীয়তা প্রদান করেছে। দেশের পুরাকীর্তিগুলোতে টেরাকোটার ব্যবহার দেখা গেলেও পাথরের টালির ব্যবহার কেবল ছোট সোনা মসজিদেই দেখা যায়।

ছোট সোনা মসজিদের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৫২.৫ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট পুরু। দেয়ালগুলো ইটের হলেও মসজিদের ভেতরে ও বাইরে পাথর দিয়ে মোড়ানো। তবে ভেতরের দেয়ালে যেখানে খিলানের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে পাথরের কাজ শেষ হয়েছে। মসজিদের খিলান ও গম্বুজগুলো ইটের তৈরি।

মসজিদের চারকোণে চারটি বুরুজ আছে। এগুলোর ভূমি নকশা অনুযায়ী অষ্টকোণাকার। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। এগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত।

মসজিদের ছাদের ওপর তৈরি হয়েছে মসজিদের ১৫টি গম্বুজ। মাঝের মিহরাব ও পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজার মধ্যবর্তী অংশে ছাদের উপর যে গম্বুজগুলো রয়েছে, সেগুলো ঘরের ছাদের আকারে নির্মিত। এদের দুপাশে দুই সারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বাইরের যে কোনো পাশ থেকে তাকালে শুধু পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।

মসজিদের পূর্ব পাশের দেয়ালে রয়েছে পাঁচটি দরজা। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে দরজা। উত্তর দেয়ালের পশ্চিম পাশের শেষ দরোজাটির জায়গায় রয়েছে সিঁড়ি। এই সিঁড়িটি উঠে গেছে মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম দিকে দোতলায় অবস্থিত একটি বিশেষ কামরায়। কামরাটি পাথরের স্তম্ভের ওপর অবস্থিত। মসজিদের গঠন অনুসারে এটিকে ‘জেনানা মহল’ বলেই ধারণা করা হয়। তবে অনেকের মতে এটি ছিলো শাসনকর্তার নিরাপদে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা করে তৈরি একটি কক্ষ।

মসজিদের পূর্ব দেয়ালে পাঁচটি দরজা বরাবর রয়েছে পাঁচটি মিহরাব। এদের মধ্যে মাঝেরটি আকারে বড়। প্রতিটির নকশাই অর্ধ-বৃত্তাকার। মিহরাবগুলোর পাথরের ওপর অলংকরণ রয়েছে। উত্তরের মিহরাবটির ওপরে দোতলার কামরাটিতেও একটি মিহরাব রয়েছে।

ছোট সোনা মসজিদের অলংকরণে মূলত ইট ও পাথরের টেরাকোটা ব্যবহার করা হয়েছে। তবে পাথরের ওপর খোদাই করা নকশাই বেশি। মসজিদের সম্মুখভাগ, বুরুজগুলো, দরজার বিভিন্ন অংশে পাথরের উপর অত্যন্ত মিহি কাজ করা হয়েছে। লতাপাতা, গোলাপ ফুল, ঝুলন্ত শিকল, ঘণ্টা ইত্যাদি খোদাই করা কাজ মসজিদটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে দ্বিগুণ।

মসজিদের উত্তর দিকে সুন্দর একটি দিঘি রয়েছে। এককালে এতে বাঁধানো ঘাট থাকলেও এখন মৃতপ্রায়। ছোট সোনা মসজিদের দৃষ্টিনন্দন রূপ বর্তমান সময়ে অনেকটা হ্রাস পেলেও এখন পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় আগত দর্শণার্থীদের জন্য সর্বাধিক কাঙ্ক্ষিত নিদর্শন সুলতানি আমলের এই স্থাপত্য। প্রতিনিয়ত দেশ বিদেশের বহু দর্শনার্থী আসেন ছোট সোনা মসজিদ দেখতে।