শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)

উপমহাদেশের প্রথম হাদিস চর্চা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা

শফিক আল মুজাদ্দেদী

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কালের প্রবাহে ভগ্নপ্রায় ছোট ভবনটি দেবে গেছে মাটির গর্ভে; লোকে বলে, আজ থেকে হাজার বছর আগে জিকির করতে করতে এখান থেকে মাওলার সান্নিধ্যে যাত্রা করেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে যান ভারত-দুহিতা, বাংলা ভূখণ্ডের তদানীন্তন রাজধানী সোনারগাঁয় ইলমচর্চার সূতিকাগার প্রতিষ্ঠার সগৌরব ইতিহাস।

মুহাদ্দিস শাইখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)। বাংলায় আগমনকারী ইলমে হাদিসের প্রথম মুহাদ্দিস। তিনি জন্মেছিলেন বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারায়। অন্যমতে, তিনি ছিলেন ইয়েমেনের অধিবাসী। শিক্ষা লাভ করেছিলেন খুরাসানে। খুব কম বয়সেই তিনি ধর্মপ্রবণ ও তীব্র জ্ঞানাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিখ্যাত হয়ে পড়েন। একদিকে হাদিস ও ফিকহ আর অন্যদিকে রসায়ন ও প্রকৃতি বিজ্ঞানে তিনি বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। বিহারের বিখ্যাত সুফি ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানেরি (রহ.) তারই সুযোগ্য শিষ্য। সম্ভবত মোগরাপাড়ার বর্তমান দরগাহ বাড়িতে অবস্থিত ছিল তার জ্ঞানচর্চা কেন্দ্র।

১৩৭২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কায়রোতে জন্মগ্রহণকারী উসুলে হাদিসের ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)-এর জন্মের ১০০ বছর আগেই তথা ১২৭২ সনের দিকে এই বাংলায় পবিত্র হাদিসের দরস হতো, ছাত্র সংখ্যা হতো প্রায় ১০ হাজারের মতো। সুদূর বোখারা, কান্দাহার, খোরাসান, সিরিয়া, ইয়েমেন, বিহার ও দাক্ষিণাত্যের ইলম পিপাসুদের দৌড়ঝাঁপ ছিল আজকের এ বাংলায়। হাদিসের মসনদে বসতেন বাংলার প্রথম মুহাদ্দিস শাইখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)। পড়াতেন বোখারি, মুসলিম ও মুসনাদে আবু ইয়ালার মতো বিখ্যাত সব গ্রন্থ। এই মহান আলেম যখন এই বাংলায় হাদিস পড়ান তখন দামেশকে চলে ইবনে তাইমিয়ার দরস, স্পেনের কার্ডোভায় চলে ইমাম কুরতবি (রহ.)-এর দরস। তখনও ইমাম জাহাবি ও ইমাম ইবনুল কাইয়ুমের মতো অসংখ্য জ্ঞানসমুদ্রের জন্ম হয়নি।

শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর সেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপত্য আজও সোনারগাঁয়ে হাজার বছরের চাপা ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নেই কেবল সেকালের পাঠদান। মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.) আনুমানিক ৬৬৮ হিজরি (১২৭৭ খ্রিষ্টাব্দ) সনে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে দিল্লিতে আগমন করেন। অন্যমতে, আনুমানিক ১২৬১ খ্রিষ্টাবেব্দ তিনি ভারতে মামলুক সালতানাতের রাজধানী দিল্লিতে হিজরত করেন।

মামলুক সুলতান প্রথম নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ (রাজত্বকাল ১২৪৬ - ১২৬৫) তার প্রতি কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি। তার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী উলুঘ খান বলবন (রাজত্বকাল ১২৬৬-১২৮৭) সুলতান গিয়াসুদ্দিন নাম ধারণ করে দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনি সর্বব্যাপী শাইখের প্রতাপকে সাম্রাজ্যের জন্য ঝুঁকি মনে করে আতঙ্কিত হন। অতঃপর তাঁকে কৌশলে নির্দেশ করলেন দিল্লি ত্যাগের।

সুলতান গিয়াসুদ্দিনের নির্দেশে বিনাবাক্য ব্যয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। অতঃপর ছুটে আসেন বাংলায়, তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ের মোগরাপারায় এসে দ্বীন প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। গড়ে তোলেন একটি মাদরাসা ও সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এখানেই সূচিত হয়েছিল উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধর্মীয় জ্ঞান চর্চার উদ্দীপনাময় ইতিহাস। এখনও সোনারগাঁয়ে ঐতিহাসিক বিদ্যাপীঠ ভবনের ধ্বংসাবশেষ তার স্বাক্ষর বহন করছে।

দালানের অলঙ্কৃত তোরণ, প্রশস্ত কক্ষ এবং দোতলায় ওঠা সিঁড়ি প্রমাণ করে যে, ভবনটি একসময় বিদ্যাপীঠ ছিল। দেয়ালগুলো প্রশস্ত এবং পুরু। ইটগুলো ছোট ছোট পাতলা, জাফরি ইট। চারপাশের দেয়ালে মেঝের তিন ফুট ওপর থেকে প্রায় ছাদ পর্যন্ত রয়েছে ইটের গাঁথুনিতে করা বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্রাকার চারকোণা খোপ। ধারণা করা হয়, এসব খোপে কিতাবাদি রাখা হতো এবং এটিই ছিল তখনকার সময়ের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।

দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ ও জানালাবিহীন কক্ষ। ভবনের পূর্বপাশ দিয়ে একটি অপ্রশস্ত সিঁড়ি ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে নেমে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে দু’জন একসঙ্গে নামার উপায় নেই। আট থেকে দশ সিঁড়ি নামার পর মোড় নিতে হয় হাতের বাঁ দিকে, অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না, গা ছমছম করে। সেখানে দশ বর্গফুটের একটি কক্ষ আছে, উচ্চতা বড়জোর ছয় ফুট, একেই বলা হয় আন্ধার কোঠা। শাইখ আবু তাওয়ামা (রহ.) এই কুঠুরিতে বসে নির্জনে জিকির ও ধ্যান করতেন। টিকে থাকা এ জীর্ণ ভবনটির লাগোয়া আরও কয়েকটি ভবন ছিল, যা এরই মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলায় আসার পথে তিনি বিহারের মানের শহরে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মাখদুমুল মুলক ইয়াহইয়া মানেরির সঙ্গে পরিচিত হন এবং তার পনের বছর বয়সী ছেলে শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি শাইখের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

শাইখ আবু তাওয়ামা (রহ.) তার ইলমের প্রতি তলব ও মেধার প্রখরতা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। অতঃপর প্রিয় শিষ্য শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরিকে দিয়ে শুরু করেন ভারত ভূমিতে ইলমে হাদিস চর্চার প্রথম বিদ্যাপীঠ। গড়ে তোলেন সমৃদ্ধ কুতুবখানা। ইলমের মধু আহরণে মধুমক্ষিকাদল সুদূর বোখারা, কান্দাহার, খোরাসান, সিরিয়া, ইয়েমেন, বিহার ও দাক্ষিণাত্য থেকে ছুটে আসেন। ধারণা করা হয়, তখন এ বিদ্যাপীঠের ছাত্রসংখ্যা ছিল ১০ হাজার।

ইলমে দ্বীনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপর এখানে শিক্ষা প্রদান করা হতো। অধিবিদ্যা, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, আইনশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, নৌবিদ্যা, ভেষজশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, ভূগোলশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান কিংবা দর্শনশাস্ত্র- এহেন কোনো বিষয় ছিল না; যা এখানে পড়ানো হতো না।

সময়ের ব্যবধানে এটি শুধু বিদ্যাপীঠই থাকেনি, হয়ে উঠেছিল সমাজ-রাজনীতির শোধনাগার। তার ছিল নিজস্ব নৌবাহিনী, প্রবল ও অপ্রতিরোধ্য বাহিনী পদাতিক বাহিনী। ছাত্ররা ইলমচর্চার পাশাপাশি ছিল বাংলার জনগণের নিরাপত্তার আমানতদার। বাংলার ধর্মজীবনের শুদ্ধি ও সুরক্ষা, সাংস্কৃতিক সচেতনতা, স্বাধীনতা ও জাতীয় সংহতি রক্ষা, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি, হানাদারদের প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে নির্ভরতার কেন্দ্র ছিল এই বিদ্যাপীঠ।

দীর্ঘ ২৩ বছর ইলমের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন মুহাদ্দিস শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)। পাশাপাশি জনসাধারণের আত্মশুদ্ধির মানসে তিনি একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তিন ছিলেন বিখ্যাত সোহরাওয়ার্দীয়া তরিকার পীর। তিনি ‘মানজিলে মাকামাত’ নামে অধিবিদ্যা (তাসাউফ) বিষয়ে একটি কিতাব লিখেছিলেন বলে জানা যায়।

এ ছাড়াও সোনারগাঁ বিদ্যাপীঠে অবস্থানকালে শাইখ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আইনশাস্ত্রবিষয়ক যেসব বক্তৃতা দিয়েছেন, সেগুলোর সংকলন নিয়ে ফারসি ভাষায় রচিত ‘নামায়ে হক’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এ গ্রন্থে ১৮০টি কবিতা আছে। কেউ কেউ তা ‘মসনবি বনামে হক’ নামে অভিহিত করেছেন। গ্রন্থটি ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) থেকে এবং ১৯১৩ অব্দে কানপুর থেকে প্রকাশিত হয়। জানা যায়, শাইখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর লিখিত পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ জাদুঘরের আর্কাইভ ভবনে রক্ষিত আছে।

শাইখ শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর পাঠদান ছিল উন্মুক্ত, তাতে প্রশাসক, আলেম, পর্যটক বা বিদেশি ও সাধারণ যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারতেন। খুব ভিড় জমতো তার ইলমি দরসের মজলিসে। একসময় তিনি একান্তে মাওলার স্মরণের জন্য জনসমাগম থেকে দূরে ‘আন্ধার কোঠায়’ চলে যান। আনুমানিক ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে সেখান থেকে মাওলার নৈকট্যে রওয়ানা দেন। তাঁর মৃত্যুর পর বিদ্যাপীঠের পরিচালক হন শাইখ শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরি (রহ.)। তিনি ছিলেন তাওয়ামার প্রকৃত ভাবশিষ্য এবং তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা ও জ্ঞানতত্ত্বে পরিপক্ব।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, শরফুদ্দিন ইয়াহইয়া মানেরির এই পূর্ণতা শাইখ আবু তাওয়ামার সাহচর্যে, এই সোনারগাঁয়েই হয়েছিল। মানেরি শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তা নয়, সুন্নতের আলোকে জীবন পরিচালনায় নিজেই ছিলেন আদর্শ। তাঁর দৃঢ়তা ছিল পাহাড়সম। ছিলেন বিনয়ী ও নিবেদিতপ্রাণ। পরে শেখ আলাউদ্দিন আলাউল হক, তাঁর পৌত্র শেখ বদর-ই-ইসলাম ও প্রপৌত্র শেখ জাহিদ সোনারগাঁয়ে ধর্মতত্ত্ব ও সুফিতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। আবু তাওয়ামা (রহ.) প্রতিষ্ঠিত খানকাহ ও মাদ্রাসা সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর আধ্যাত্মিক অনুসারীদের দ্বারা এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত সুফি সাধক সাইয়িদ ইবরাহিম দানিশমন্দ ও তাঁর বংশধর সৈয়দ আরিফ বিল্লাহ মুহাম্মদ কামেল, সাইয়িদ মুহম্মদ ইউসুফ ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

সোনারগাঁও এক সময়ে ছিল বিখ্যাত সুফি দরবেশ ও ফকিরদের মিলনক্ষেত্র। সোনারগাঁয়ে সংকলিত কতিপয় মূল্যবান গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (রহ.) রচিত ইসলামি সুফিবাদবিষয়ক দুর্লভ গ্রন্থ মাকামাত, আবু তাওয়ামা কর্তৃক রচিত অথবা তার প্রদত্ত শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে তার কোনো অনুসারী কর্তৃক সংকলিত (১৩০৪) ফার্সি ভাষার ফিকাহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থ নামণ্ডই-হক, ১৪ শতকের প্রথমদিকে জনৈক কামাল-ই-করিম বিরচিত ফিকাহ শাস্ত্রীয় গ্রন্থ মাজমুণ্ডই-খানী ফি আইন আল-মাআনি, সোনারগাঁয়ের তুগলক শাসনকর্তা বাহরাম খান ওরফে তাতার খানের নির্দেশে সংকলিত তাফসির-ই-তাতারখানি ও ফতওয়ায়ে তাতারখানি এবং মুসা খানের সভাকবি নাথুরেশ কর্তৃক সংকলিত সংস্কৃত-বাংলা অভিধান শব্দণ্ডরত্নকরী। পূর্ব বাংলার মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায় পর্যন্তই এর এই গৌরব অব্যাহত ও অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু পরবর্তী ব্রিটিশ শাসনামলে সোনারগাঁ স্বর্ণকিরণ নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায়।

সোনারগাঁ মোগরাপাড়ায় প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে কয়েকজন উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম পাওয়া যায়, যাদের নামের শুরুতে পদবি হিসেবে যুক্ত ছিল মুহাদ্দিস শব্দটি। ধারণা করা হয়, তারা সবাই সরাসরি বা শিক্ষাপরম্পরায় শাইখ আবু তাওয়ামা (রহ.)-এর ছাত্র ছিলেন। প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি প্রত্যেকেই হয়তো মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও হাদিস শিক্ষাদানে নিযুক্ত ছিলেন।’