মুসলিম-অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই ইসলাম শান্তি, সাম্য ও সহানুভূতির নির্দেশ প্রদান করে। ধর্মে ভেদাভেদ থাকলেও আচার-আচরণ, চলাফেরা, বিচার-সালিশে ইনসাফের ওপরই চলার নির্দেশ দেয় ইসলাম। কারও ব্যাপারে কোনো পক্ষপাতের স্থান নেই ইসলামে। এমনিভাবে এক ধর্মকে অন্য ধর্মের ওপর জোরপূর্বক কোনো বিধান চাপিয়ে দেওয়াকেও ইসলাম অপছন্দ করে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘ধর্ম (ইসলাম) গ্রহণে কাউকে বাধ্য করা হবে না।’ (বাকারা : ২৫৬)।
ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে কেউ দাবি করতে পারবে না যে, ইসলাম অন্য ধর্মাবলম্বীকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছে বা ভিন ধর্মের হওয়ার ফলে বেইনসাফির সঙ্গে বিচার করেছে। বরং ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনা থেকে বোঝা যায়, ইসলামি শাসনামলে অমুসলিমদের তাদের ধর্ম পালন, বিপদাপদে সাহায্য প্রদান, সৌজন্যমূলক হাদিয়া প্রেরণ, ন্যায়বিচারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বিভাজন না করে একই সঙ্গে চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া ও লেনদেনের অবকাশ রাখা হয়েছে এবং তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে, যাতে করে বিপদাপদে তারা একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে পাশে থাকতে পারে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
মানুষ হিসেবে মানুষকে সম্মান করা : অতএব, হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান যে ধর্মের অনুসারী হোক না কেন, মানুষ হিসেবে সবাই সম্মানিত। এজন্য ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) একজন ইহুদির লাশের প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আর আমি অবশ্যই আদম সন্তানকে সম্মানিত করেছি।’ (সুরা ইসরা : ৭০)।
একবার রাসুলে কারিম (সা.) এর পাশ দিয়ে এক ইহুদির লাশ অতিক্রম করছিল, তখন তিনি দাঁড়ালেন। সহাবায়ে কেরাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা তো একজন ইহুদির লাশ, আপনি কেন দাঁড়াচ্ছেন?’ নবীজি (সা.) উত্তর দিলেন, ‘এটা কী একটা মানুষের লাশ নয়?’ (বোখারি : ১২৫০)।
ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গালি না দেওয়া : ইসলাম এমন একটি মহান ধর্ম যে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গালি দিতেও নিষেধ করেছেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘আর তোমরা তাদের প্রতিমাগুলোকে গালি দিও না, ফলে না জেনে তারাও আল্লাহকে গালি দেবে।’ (আনয়াম : ১০৮)।
ইসলাম ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ধর্মপালনে তাদের কখনও বাধাগ্রস্ত করে না। যেমন একদিন আবু বকর (রা.) একটি কাফেলাকে দাওয়াতের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করে বললেন, ‘তোমাদের পথিমধ্যে অমুক ধর্মের অনুসারীদের উপাসনালয় পড়বে। খবরদার, সেগুলো তোমরা ভেঙ্গ না। কারণ তারাও সেখানে আল্লাহকে পাওয়ার উদ্দেশে উপাসনা করে।’ (ফুতুহুস শাম, ওয়াকিদি : ১/৮)।
ক্ষমার মাধ্যমে সহানুভূতি : মক্কার যে মানুষগুলো নবীজিকে এক সময় তার মাতৃভূমি ছাড়তে বাধ্য করেছিল, যখন তিনি মক্কা বিজয় করলেন, সে সময় মক্কার অধিবাসীরা মনে করছিল আজ আমাদের সবাইকে হত্যা করা হবে। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে দয়ার নবী (সা.) কিছু দুর্ধর্ষ ব্যক্তি ছাড়া সম্প্রীতি সৃষ্টির লক্ষে সবাইকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিলেন এবং অমুসলিমদের মক্কায় নিজ বাড়িতে থাকার অনুমতিও দেন। জোরপূর্বক মুসলমান হতে কাউকে বাধ্য করেননি। তাই মক্কা বিজয়ের এ ঘটনা থেকে ইসলাম এ শিক্ষা দেয়, ইসলাম ক্ষমা ও সহানুভূতির ধর্ম।
হাদিয়া প্রদানের মাধ্যমে সহানুভূতি প্রদর্শন : প্রখ্যাত তাবেঈ মুজাহিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনে আমরের কাছে উপস্থিত ছিলাম। সে সময় তার এক ছেলে একটি ছাগলের চামড়া ছাড়াচ্ছিল। এমন সময় তিনি তার ছেলেকে বললেন, চামড়া ছাড়ানো হলে আগে আমাদের এ ইহুদি প্রতিবেশীকে দিয়ে বিতরণ শুরু করবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, ইহুদি আপনার কী এমন উপকার করল যে, তাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন? জবাবে তিনি বললেন, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিবেশীদের হক সম্পর্কে এ পরিমাণ খেয়াল রাখার কথা বলতেন, মাঝেমধ্যে আমরা মনে করতাম, হয়তো তিনি তাদের আমাদের উত্তরাধিকার বানিয়ে দেবেন। (আদাবুল মুফরাদ, বোখারি : ৯৫)।
বিশ্বনবী অমুসলিমদের দাওয়াত গ্রহণ করেছেন : রাসুলের প্রিয় সাহাবি আনাছ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ইহুদি নবী (সা.) কে যবের রুটি ও চর্বিযুক্ত খাদ্যের দাওয়াত দিল, নবীজি (সা.) তার দাওয়াত কবুল করেছিলেন। (মুসনাদে আহমদ : ১৩২২৪)।
অমুসলিম কর্তৃক জবাইকৃত প্রাণী ব্যতীত তাদের সব খাবার মুসলিমদের জন্য বৈধ : মুসলিম ও অমুসলিমরা পরস্পর সহজে যেন জীবনযাপন করতে পারে, এজন্য খাদ্যদ্রব্যসহ যাবতীয় হালাল পণ্যের লেনদেনের বৈধতা দিয়ে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘আহলে কিতাবের খাদ্যদ্রব্য তোমাদের জন্য হালাল করা হলো।’ (মায়েদা : ৫)।
সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে সহানুভূতি : সাহায্য-সহযোগিতা শুধু মুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং অমুসলিমদের দেওয়ার অনুমতি রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মনোরঞ্জনের জন্য অমুসলিমদের সদকা দেওয়া যাবে।’ (তাওবা : ৬০)।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) এর সময়ে যখন ভিন্নধর্মের কোনো লোক অসুস্থ বা বৃদ্ধ হয়ে কর্মে অক্ষম হয়ে যেত, তখন তিনি তার বার্ষিক ‘কর’ মওকুফ করে দিতেন এবং বায়তুল মাল থেকে তার ও তার পরিবারের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতেন। (কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ : ৩০৬)।
এ ব্যাপারে আরও একটি ঘটনা হচ্ছে, একবার ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) একগোত্রের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে এক অসহায় বৃদ্ধ তার পেছন থেকে ধরে বসল। ওমর (রা.) বিনয়ের সঙ্গে বললেন, তুমি কোন ধর্মের অনুসারী? সে বলল, ইহুদি। জিজ্ঞেস করলেন, কি দরকার? বৃদ্ধ বললেন, কর মওকুফ, কিছু সাহায্য ও বার্ধক্য ভাতা। ওমর (রা.) তাকে সর্বপ্রথম নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। পর্যাপ্ত খাদ্যদ্রব্য ও সাহায্য প্রদান করলেন। এরপর বায়তুল মালের হিসাবরক্ষকের কাছে তাকে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, এ বৃদ্ধ এবং তার মতো আরও যত বৃদ্ধ আমাদের দেশে আছে, সবার কর মওকুফ করে দাও এবং খাদ্যভান্ডার থেকে তাদের সাহায্য কর। এমন ব্যবহার কিছুতেই সমীচীন নয় যে, আমরা তাদের যৌবনের শুল্ক গ্রহণ করে বার্ধক্যে তাদের অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেব? (কিতাবুল খারাজ, আবু ইউসুফ : ১২৬)।
মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পক্ষপাতহীন ন্যায়বিচার : ওমর ইবনুল আজিযের কাছে এক অমুসলিম এসে আব্বাস ইবনুল ওয়ালিদের বিরুদ্ধে তার জমি দখলের বিচার দায়ের করল। আব্বাসকে জিজ্ঞেস করা হলো, এ ব্যাপারে তুমি কী বলো। সে বলল, আমার পিতা ওয়ালিদ জমিটি আমার ভাগে দিয়েছেন এবং তার ওপর আমার কাছে একটি দলিল আছে। অমুসলিমকে জিজ্ঞেসা করা হলো, এবার তোমার বক্তব্য কী? সে বলল, আমি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা চাই। তখন আমিরুল মুমিনিন বললেন, হে আব্বাস! আল্লাহর কিতাব তোমার দলিলের চেয়ে উত্তম। তোমার জমিটি এ ব্যক্তিকে ফিরিয়ে দাও। তখন আব্বাস জমিটি ফিরিয়ে দিল। (বিদায়া ও আন-নিহায়া : ৯/২১৩)।
এ ব্যাপারে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা ইনসাফের সঙ্গে সাক্ষ্য প্রদান করো। আর কোনো গোত্রের ওপর ক্ষোভ যেন তোমাদের বেইনসাফি করতে উদ্যত না করে। ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে বিচার করো। কারণ, ন্যায়পরায়ণতা তাকওয়ার নিকটবর্তী।’ (সুরা মায়িদা : ৮)।
আল্লামা বায়যাবী বলেন, ওই আয়াতে ‘কওম’ তথা গোত্র দ্বারা মূর্তিপূজকরা উদ্দেশ্য। (আনওয়ারুত তানযীল : ২/৩০৩)।
মূলত এ কারণেই ইসলামের সুদীর্ঘ শাসনামলে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো বড় ধরনের সংঘাত পরিলক্ষিত হয়নি। ধর্মের রীতিনীতির বৈচিত্র্য থাকলেও অন্যান্য সব বিষয়ে কাঁধে কাঁধ রেখে হাতে হাত রেখে একসঙ্গে চলার অভ্যাস গড়ে নিয়েছিল তারা।
ভারতবর্ষেও মুসলিম শাসক বাবরসহ মুঘলদের আমলেও মুসলিম ও অমুসলিমরা পরস্পর সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ উপনিবেশের ফলে এবং তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে এদেশের মুসলিম ও অমুসলিমদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাদের চক্রান্ত এখনও থেমে নেই। এখনও যদি আমরা তাদের এ চক্রান্ত না বুঝে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে থাকি, তাহলে আগামীতে আরও লোমহর্ষক কালো ইতিহাস রচিত হতে পারে। আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে, সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। আর একসঙ্গে বসবাস করতে হলে কিছুটা বৈচিত্র্য থাকবেই। আর এই বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য গড়তে হবে। তাই আসুন, আমরা (হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান) যেই হোক না কেন, পরস্পর ভাই-ভাইয়ের মতো মিলেমিশে বসবাস করি এবং সুন্দর বাংলাদেশ গড়ি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন।