কর্মচারীদের ক্ষমা করা ইবাদত
ফারহান হাসনাত
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জগতে মানুষই আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি। বড় ভালোবেসে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহতায়ালা। মানুষের অধীন করে দিয়েছেন সৃষ্টির সব কিছু। আল্লাহতায়ালা মানুষকে নানা স্তরে ও বিচিত্র শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। কেউ শাসক, কেউ শাসিত। কেউ মালিক, কেউ কর্মচারী। কেউ শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। একজন যেন অন্যজনের মাধ্যমে নিজের কাজ আদায় করে নিতে পারে, পৃথিবীর অবস্থা সুশৃঙ্খলভাবে চলতে পারে, এজন্যই এই শ্রেণিভেদ। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাদের মধ্যে তাদের জীবিকা বণ্টন করেছি পার্থিব জীবনে এবং একের মর্যাদাকে অপরের ওপর উন্নীত করেছি, যাতে তাদের একে অন্যের দ্বারা কাজ করে নিতে পারে।’ (সুরা জুখরুফ : ৩২)।
এই শ্রেণিভেদ তৈরি করা হয়েছে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়; বরং তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এবং একে অন্যের ওপর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন, যাতে তোমাদেরকে প্রদত্ত বিষয়ে পরীক্ষা করেন।’ (সুরা আনয়াম : ১৬৫)।
ধনী ও মনিবশ্রেণির কর্তব্য হলো, কর্মচারীরা তাদের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ- এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে কর্মচারীদের সঙ্গে সদাচরণ করা। কারণ, কর্মচারী কখনও মনিবের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। অন্যদিকে কর্মচারীর কাজ করতে হয় বেশি। ফলে তার ভুল হওয়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে। এ কারণেই মনিবের কর্তব্য হলো, তাকে বেশি বেশি মাফ করা। কারণ প্রত্যেক ভুলের কারণে যদি কথা দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়, তা হলে ওই কর্মচারী সারাবছর দুঃখভারাক্রান্ত থাকবে, মর্মাহত থাকবে। এ কারণেই কর্মচারীকে ক্ষমা করা ও প্রতিটি ভুলে তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন না করা হলো রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অন্যতম সুন্নাহ। আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, সেবককে (গোলামকে) আমি কতবার মাফ করব?’ প্রশ্ন শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) চুপ রইলেন। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, সেবককে (গোলামকে) আমি কতবার মাফ করব?’ এবার তিনি উত্তরে বললেন, ‘প্রতিদিন ৭০ বার।’ (তিরমিজি : ১৯৪৯)।
একজন সেবক তো প্রতিদিন ৭০ বার ভুল করতে পারে না। সুতরাং হাদিসের মর্ম হলো, সব সময় তাকে মাফ করেই যেতে হবে।
আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি ১০ বছর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সেবা করেছি। আল্লাহর শপথ করে বলছি। কখনও তিনি উফ শব্দটিও আমাকে বলেননি। কোনো কাজ করার পর ‘এভাবে করলে কেন?’, ‘ওভাবে করলে না কেন?’ এমনটি বলেননি।’ (মুসলিম : ২৩০৯)।
অফিসের কর্মচারী, অধীনস্থ লোক, বাড়ির বুয়া, দারোয়ান ও সেবকদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তারা আমাদের ভাই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তারা তোমাদের ভাই, তাদেরকে আল্লাহ তোমাদের অধীন করেছেন।’ (বোখারি : ৩০)।
শ্রমের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক তথ্য খুবই প্রাসঙ্গিক। তা হলো, নবী-রাসুলগণের প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষভাবে শ্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। মুসনাদে আহমদের হাদিস মতে, সব নবী-রাসুলই মেষ চড়িয়েছেন; এমনকি শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও মেষ চড়াতেন। শ্রমের অনেক ফজিলতের কথাও হাদিসে এসেছে। বোখারির হাদিস মতে, কারও কাছে হাত পাতার চেয়ে কারও বোঝা বহন করে রোজগার করা উত্তম। কেউ কিছু দিক আর না দিক, কারও কাছে কিছু চাওয়ার চেয়ে নিজ পিঠে করে কাঠের বোঝা নিয়ে বাজারে বিক্রি করা অনেক ভালো। এখানেও সেই শ্রমেরই গুরুত্ব ফুটে ওঠে। বিখ্যাত বুজুর্গ ও ইসলামি পণ্ডিতেরা নিজেদের নামের সঙ্গে আত্তার বা আতর ব্যবসায়ী, খাব্বাজ বা রুটি ব্যবসায়ী, কাত্তান বা তুলা উৎপাদনকারী প্রভৃতি পেশাভিত্তিক উপাধি ধারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি।
আবু দাউদের হাদিস মতে, যে ব্যক্তি আয়-রোজগারের জন্য শ্রম ব্যয় করবে সে যেন আল্লাহর পথে জিহাদে রত রয়েছে। কেউ যদি তার সন্তান বা স্ত্রী অথবা বাবা-মায়ের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে সে নিঃসন্দেহে আল্লাহর পথেই বিচরণ করছে। তাবরানির হাদিস মতে, ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় যে শ্রমিক সন্ধ্যাযাপন করল, সে নিঃসন্দেহে যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে সন্ধ্যা অতিক্রম করল। একজন শ্রমিকের জন্য এটি সর্বোত্তম এক প্রণোদনা- যা ইসলাম তাকে দিয়েছে।
সব চাকরিজীবীরই কিছু ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে স্বার্থ হাসিল করা ক্ষমতার সুস্পষ্ট অপব্যবহার। এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কারও ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা বা পদণ্ডপদবি ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করা ইসলামের দৃষ্টিতে বড় অন্যায় ও জুলুম। আবু হুমাইদ আস-সাঈদি (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আসদ গোত্রের ইবনে লাতবিয়া নামক এক ব্যক্তিকে জাকাত উসুলের জন্য কর্মচারী নিযুক্ত করে কোথাও পাঠালেন।
তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের অর্থাৎ রাষ্ট্রের আর এগুলো আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে দাঁড়ালেন। আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, ‘সে কর্মচারীর কী হলো, যাকে আমি দায়িত্ব দিয়ে পাঠালাম, আর সে বলে, এগুলো আপনাদের এবং এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে? সে তার ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন, তাকে উপহার দেওয়া হয় কি না?’ (মুসলিম : ৪৮৪৩)।
