জিনের মসজিদ

মোস্তফা কামাল গাজী

প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রায় দুইশ বছর আগের কথা। তখন মেঘনা ও খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদীর মোহনা লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলা ছিল জনবিরল বিশাল চরাঞ্চল। সময়ে সময়ে এখানে আগমন ঘটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মহান কিছু ধর্ম সাধকদের। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসার ঘটেছে এই এলাকাকে কেন্দ্র করেই। সে সময় রায়পুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা আবদুল্লাহ। জন্মের পর শিশু আবদুল্লাহর মধ্যে ব্যতিক্রমী জীবন লক্ষ্য করা যায়। যখন সে কথা বলা শেখে তখন থেকেই তার মধ্যে আধ্যাত্মিকতার ভাব প্রকাশ পায়। সময়টি ছিল ১৮২৮ সাল। ধার্মিক পরিবারে জন্ম নেওয়া আব্দুল্লাহ নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশে পাড়ি জমান ভারতে। সেখানে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় দীর্ঘ ১৭ বছর অভিজ্ঞ ও প্রসিদ্ধ আলেমদের সান্নিধ্যে থেকে উচ্চতর জ্ঞান অর্জন ও দ্বীনি শিক্ষালাভ করেন। ভারতে পড়ালেখা শেষ করে বাংলাদেশে ফেরার পথে তিনি কিছুদিন দিল্লিতে অবস্থান করেন।

এ সময় দিল্লি শাহি জামে মসজিদের নির্মাণশৈলী ও শৈল্পিক অবয়ব তাকে আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশে ফিরে অনুরূপ একটি মসজিদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার প্রবল আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছে শক্তিকে লাগিয়ে নিজ এলাকায় এসে আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদ নির্মাণে অগ্রসর হোন। দেখতে দেখতে তিনি দিল্লির শাহি জামে মসজিদের হুবহু নমুনার ১১০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭০ ফুট প্রস্থ এবং মাটি থেকে ১০ ফুট উঁচুতে ৩টি গম্বুজবিশিষ্ট বিখ্যাত এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। অধিকাংশ এলাকাবাসীর মতে, ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মসজিদটি।

মসজিদের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হলো, এর তলদেশে ২০ ফুট নিচে রয়েছে ৩ কামরা বিশিষ্ট গোপন ইবাদতখানা। নির্জন পরিবেশে সেখানে বসে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন মাওলানা আবদুল্লাহ।

মসজিদের ভিটির উচ্চতা ১৫ ফুট। ১৩ ধাপ সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হয়। দেয়ালের প্রস্থ ৮ ফুট। মসজিদের সম্মুখের জরাজীর্ণ মিনারটির উচ্চতা ২৫ ফুট।

কথিত আছে, মসজিদের নির্মাণ কাজ মাওলানা আবদুল্লাহর কিছু শিষ্য জিন রাতের আধারে মসজিদের নির্মাণ কাজ করে দিত। তাই এই ঐতিহাসিক মসজিদটি জিনের মসজিদ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। এলাকাবাসী এখনও বলেন, মসজিদের তলদেশে স্থাপিত পুকুরগুলোতে জিনরা গোসল করত। তারা নাকি মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায়সহ জিকির-আজকার অন্যান্য ইবাদত করতো। এমনকি গভীর রাতে জিকিরের আওয়াজ অনেক দূর থেকেও শোনা যেত।

আবার বিভিন্ন কাজে দিনের বেলা এ এলাকা দিয়ে দূরদূরান্তে যাতায়াতের সময় অনেকে নাকি দেখতেন, কেউ কাজ না করলেও প্রতিদিনই বাড়ছে মসজিদটির আকার। প্রতিদিনই সকালবেলা দেখা যেতো নির্মাণ কাজ আগের দিনের চেয়ে অনেকখানি এগিয়েছে। ফলে তাদের বিশ্বাস জন্মে একদল জিন হয়তো রাতের বেলা লোকচক্ষুর অন্তরালে তৈরি করছে মসজিদটি।

সেই থেকে মসজিদটি জিনের মসজিদ হিসেবে পরিচিত। এখনও এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস এমনই। তবে এর প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন। মাওলানা আবদুল্লাহর নাতি শিহাব উদ্দিন ও মসজিদের মুয়াজ্জিন রুহুল আমিন বলেন, এ বুজুর্গের সহচরদের অধিকাংশই ছিল গরিব শ্রেণির।

দিনেরবেলা তারা নিজেদের জীবিকা অর্জনে কাজ করতেন আর রাতের বেলা মাওলানা আবদুল্লাহর নির্দেশনায় স্বেচ্ছায় করতেন মসজিদ নির্মাণের কাজ। ফলে এ অঞ্চল দিয়ে দিনেরবেলা যাতায়াতকারীরা মনে করতেন, কেউ নির্মাণকাজ না করলেও আপনা আপনিই এগিয়ে যাচ্ছে মসজিদের নির্মাণকাজ। এতে তাদের ধারণা হয়, হয়তো জিনই বানাচ্ছে মসজিদটি। সে ধারণা নিয়ে তারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে প্রচার করতে থাকেন এ কথা। তাছাড়া মাওলানা আবদুল্লাহর আধ্যাত্মিকতা আর দ্বীনি জ্ঞানের প্রসিদ্ধির কারণে এ প্রচারণা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।

মসজিদের সঙ্গে জিন জাতিকে জড়িয়ে আরও বহু কথা প্রচলিত আছে রায়পুর উপজেলা এবং তার আশপাশের অঞ্চলে। এখনও বহু মানুষ নিয়ত-মানত করে নামাজ পড়তে আসেন মসজিদটিতে। উপকারের আশায় মসজিদ সংলগ্ন কূপের পানি নিয়ে যান তারা। মসজিদের সামনের পুকুর থেকে মাটি কেটে পুড়িয়ে বানানো হয় মসজিদ তৈরির ইট।

ঐতিহাসিক এই মসজিদ লক্ষীপুর জেলার রায়পুর পৌর শহর থেকে ৮-৯ শত গজ আগে পীর ফয়েজ উল্লাহ সড়কের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। মসজিদটির নান্দনিক রূপায়ণ ও অদ্ভুত অবকাঠামো এবং শৈল্পিক অবয়বের দিক থেকে এটি লক্ষ্মীপুর জেলার একটি প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর নির্মাণ কৌশল ও স্থাপত্যকলা দেখতে হাজার হাজার দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে। মসজিদটি রায়পুরের কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

মসজিদটি এলাকায় ‘মৌলভি আবদুল্লাহ সাহেবের মসজিদ’ বলেও পরিচিতি রয়েছে। তবে মসজিদের সামনে সিঁড়ির কাছে লাগালো শিলালিপি থেকে জানা যায়, মসজিদের মূল নাম ‘মসজিদে জামে আবদুল্লাহ’।

মসজিদে একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন ৫০০ জন মুসল্লি। স্থানীয় মুসল্লিদের অনুদানের টাকায় মূল নকশা ঠিক রেখে বেশ কয়েকবার মসজিদের সংস্কার কাজ করা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণও চলে মুসল্লিদের তত্ত্বাবধানেই। মুয়াজ্জিন রুহুল আমিন বলেন, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে সংস্কার কাজের জন্য একবার মাত্র সরকারি বরাদ্দ পাওয়া গিয়েছিল। এরপর আর কখনও কোনো সরকারি অনুদান পায়নি কালের সাক্ষী এই ঐতিহাসিক মসজিদটি।