ঢাকা শুক্রবার, ০১ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শিক্ষায় নৈতিকতার অবক্ষয় ও নৈতিক শিক্ষার আবশ্যকতা

ড. মুহাম্মদ এনামুল হক আজাদ
শিক্ষায় নৈতিকতার অবক্ষয় ও নৈতিক শিক্ষার আবশ্যকতা

যুগে যুগে শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত-দার্শনিকরা শিক্ষার যে উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে আসছেন বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা সে উদ্দেশ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে প্রকৃত মানবিক গুণে গুণান্বিত করা। কিন্তু এখন শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে জাগতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অর্থ-সম্পদ, আয়-উপার্জন করা এবং এর কলাকৌশল আয়ত্ত করা। এখানে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বা নৈতিক-অনৈতিকের কোনো বালাই নেই। নেই মানবতা বা মানবিকতার কোনো মূল্য। কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত কিছু বক্তব্যের সত্যতার প্রমাণ মিলবে। দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশিত ‘বাণিজ্যের হাতিয়ার শিক্ষা’ শিরোনামের প্রবন্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁস, অধিক সংখ্যক পাস ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার ধারায় প্রবন্ধকার লেখেন, ‘শিক্ষাও সম্পূর্ণভাবে একটা বাণিজ্য হয়ে গেছে, এখন যে যার মতো এখান থেকে বাণিজ্য করে নিতে চাইছে। স্বভাবত প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের কাজটি অনেক ক্ষেত্রে লাটে উঠেছে। প্রধান শিক্ষক তাই পাঠদানে আন্তরিক নন, তিনি ব্যস্ত থেকেছেন কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে ছাত্রদের ভালো ফলাফল পাইয়ে দেওয়া যায় সে জন্য। এই রেজাল্ট দেখিয়ে বেশি করে ছাত্র ভর্তি করিয়ে নিয়ে বেশি আয় করবেন, এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আর শিক্ষার মান সংরক্ষণ ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য রাষ্ট্রের নিয়োজিত শিক্ষা কর্মকর্তা এটিকে দেখেছেন স্রেফ তার কিছু বাড়তি অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার কাজ হিসেবে। হিসাবে দেখা গেল, রক্ষক সম্পূর্ণরূপে ভক্ষকে পরিণত হয়েছেন। এ অবস্থায় কল্পনা করা কঠিন নয় যে, আসলে বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় কি ধরনের রূপান্তর ঘটেছে।’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ০১-০৯-২০১৬ইং)।

‘গবেষণা নিয়ে জালিয়াতি’ শিরোনামে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ রিপোর্ট করেছে, ‘দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দায়সারা গবেষণা কার্যক্রম চলছে। চাকরির প্রমোশন পেতে অযোগ্যরা চাকরি বাগিয়ে নিতে করছেন গবেষণা। ফলে জ্ঞান সৃষ্টি নয়, চাকরি বা প্রমোশনের উদ্দেশ্য হাসিলই গবেষণার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫-০১-২০১৭ইং)।

দৈনিক ইনকিলাব রিপোর্ট করেছে, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদ-’ এই আপ্তবাক্য জন্মের পর থেকে শুনলেও বাস্তবতা হলো ‘শিক্ষাই ভাঙছে জাতির মেরুদ-। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা, অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত, আপসকামিতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অনৈতিকতা, অপেশাদারি মানসিকতা, অর্থের প্রতি লোলুপতাই মূলত এ জন্য দায়ী।’ (দৈনিক ইনকিলাব, ১০-১২-২০১৬)।

উপরে যাদের কথা বলা হয়েছে তারা কেউ অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত নন বরং শিক্ষাই অনেকের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু চরিত্রে শিক্ষার কোনো ছাপ নেই। আছে শুধু প্রভাব-প্রতিপত্তি ও প্রাচুর্যের লালসা। যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত ‘উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত হবে তো?’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনুমোদিত আইনের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিলের গঠন ও ক্ষমতা পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ কাউন্সিল যদি সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে এবং পক্ষপাতদুষ্ট ও দুর্নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়ে সত্যিকার অর্থেই নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, তবে তা এ দেশের উচ্চশিক্ষার ফেরিওয়ালাদের রুখতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে। যদিও সময়ই বলে দেবে এ কাউন্সিল সত্যিকার অর্থেই সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে কি না।’ (যুগান্তর-২৫-১০-২০১৬)।

সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল আইন ২০১৬-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভার ১০ অক্টোবর ২০১৬ এর নিয়মিত বৈঠক। এ কাউন্সিল হবে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট : যার একজন চেয়ারম্যান, চারজন পূর্ণকালীন ও আটজন খ-কালীন সদস্য হবেন। এতে বুঝা যাচ্ছে, কাউন্সিলের সদস্যরা হবেন দেশের বাঘা বাঘা উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। তাদের ব্যাপারে লেখকের এরূপ সংশয় প্রকাশ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার যথার্থতার ওপর একটি বড় আকারের প্রশ্ন বৈকি? ‘ঘুষের হাট চট্টগ্রাম কাস্টম, মাসে অবৈধ লেনদেন শতাধিক কোটি টাকা।’ (যুগান্তর, ২৫-০১-২০১৭)

‘রাজধানীতে দেড়শ’ স্পট, অভিজাত ক্লাবে রাতভর জুয়ার আড্ডা। উড়ছে কোটি কোটি টাকা, চালকের আসনে সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা’, ‘পাড়ায় পাড়ায় বাড়ছে কিশোর সন্ত্রাসী, জড়াচ্ছে ভয়ংকর অপরাধ’, ‘ভর্তি বাণিজ্য, ভিকারুননিসাসহ ১৫ প্রতিষ্ঠানে দুদকের অনুসন্ধান শুরু’, ‘রাজধানীতে ঘুষের টাকাসহ উপসচিব গ্রেপ্তার।’ (যুগান্তর, ০৯-০১-২০১৭)।

ইত্যাদি খবর ও শিরোনামগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে একথা বলে দিচ্ছে যে, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্যের সঙ্গে আজকের শিক্ষিত সমাজের আচরণের গরমিল প্রকট। তারা এর থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে অবস্থান করছে। এ আদর্শচ্যুতি ও চরিত্রহীনতার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, এর মূল কারণ হলো মানুষের জীবন-জগৎ সম্বন্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক ভ্রান্তি ও বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহপাকের প্রত্যাদেশ ও নির্দেশনাকে অগ্রাহ্য করা। তথা ধর্ম ও নৈতিকতা বর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থাই এ বিপর্যয়ের মূল কারণ।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ আলী আশরাফ (রহ.) এর একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা পেশাগত শিল্পভিত্তিক প্রজন্ম ও যুবকদের তৈরি করে, যারা নিজ নিজ পেশায় দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে; কিন্তু তারা নৈতিকতার দিক থেকে সবচেয়ে পাপাচারী বা দুরাচার হলেও তাতে কোনো অসুবিধা নেই।’ ধর্মহীন ও চরিত্রহীন নাস্তিক্যবাদী ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার ফলে শিক্ষিতরা শুধু বুদ্ধিবৃত্তির কারণে দাম্ভিক ও অহংকারী হয়ে ওঠে। গোটা মানবজাতি ধ্বংস করে হলেও তারা নিজেই পৃথিবীতে নেতৃত্ব স্থাপন করে প্রাচুর্যময় ও ভাগ্যবান হতে চায়। অন্যদের ওপর কর্তৃত্ব করা, অবৈধ বিষয়কে বৈধতার রূপদান করা, সম্পদ লুট করা, রক্তপাত করা এবং ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত করা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। এমনকি শিশু, নারী, বৃদ্ধ ও অসহায়দের জন্যও তাদের হৃদয়ে কোনো মমত্ববোধ থাকে না। সর্বশেষ দিহান-আনুশকার বর্বরোচিত ঘটনাসহ হাজারো ঘটনার জ্বলন্ত উদহারণ।

পশ্চিমারা এ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার কারণে সারা পৃথিবীতে অজস্র শহর, বন্দর, নগর ও জনপদকে বিধ্বস্ত করছে, বিনাশ করছে হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে। নির্মূল করছে অগণিত জাতিগোষ্ঠীকে। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে দৃষ্টি দিলেই এর অগণিত প্রমাণ মেলে। আজকের মুসলিম বিশ্ব এ বিধ্বংসী থাবায় চরমভাবে আক্রান্ত। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এ ভয়ংকর আক্রমণ থেকে মুক্তি পেতে হলে দেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে নৈতিক শিক্ষা তথা ইসলামি-ধর্মীয় শিক্ষা বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে নৈতিক শিক্ষা বাস্তবায়নের একটি রূপরেখা পরামর্শ আকারে অন্য লেখায় দেওয়া হয়েছে, এখানে শুধু এর আবশ্যকতাই তুলে ধরা হলো।

শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার গুরুত্ব ও এর অবস্থান উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে একথাও প্রণিধানযোগ্য যে, শিক্ষার সব স্তরেই নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নচেৎ তা যথাযথ গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে শিক্ষার্থীর মানসপটে ফুটে উঠবে না। শিক্ষার সব স্তর মিলেই একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো বিশেষ বিষয়ে পারদর্শী করার ইচ্ছা করলে তাকে শিক্ষার সব স্তরেই ওই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। তবেই সে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। ওই বিষয় থেকে সে নিজেও উপকৃত হয়, অন্যদেরও উপকার করতে সক্ষম হয়। শুধু শিক্ষার দু-একটা স্তরে কোনো বিষয় শিখলে তা পূর্ণ শিক্ষা হয় না। তা থেকে শিক্ষার্থীও পূর্ণ ফল লাভ করতে পারে না। যেমন দেখা যায়, কোনো শিক্ষার্থী প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে অঙ্ক, ইংরেজি বা আরবি পড়লেও পরবর্তী স্তরে তা না পড়লে ওই বিষয়গুলো দিয়ে সে উপকৃত হতে পারে না। আবার কেউ প্রাথমিক স্তরগুলো না পড়লে পরবর্তী স্তরে তা আর শিখতে পারে না এবং তার থেকে উপকৃত হতে পারে না। সুতরাং এ কথা আনস্বীকার্য, নৈতিক শিক্ষা যা সব মানুষের জন্য ফরজে আইন বা ব্যক্তিগতভাবে আবশ্যক, শিক্ষার্থীর জন্য তো বটেই; তা শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনব্যাপী না দিলে একজন শিক্ষার্থী পূর্ণ নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না, নৈতিকতার গুণে নিজেকে গুণান্বিত করতে পারবে না। ফলে অনেক বড় শিক্ষিত হয়েও আজকের সমাজের অনেকের মতোই থেকে যেতে হবে নৈতিকতা বর্জিত পশুসম অমানুষ, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়।

বর্তমানে ব্যাপকভাবে সংঘটিত যৌন হয়রানি, দুর্নীতি, মানব নির্যাতন ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের জন্য সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চলছে নানা আয়োজন। এগুলো প্রতিরোধের নানা উপায়-উপকরণের বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বক্তা ও লেখককেই নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলতে ও লিখতে দেখা যায়। কিন্তু তা মনে হয়, অনেকটা কথার কথা ও খ-িত কথা; দায়সারা গোছের কিছু পরামর্শ মাত্র। তাদের কথাকে পরিপূর্ণ ও যথার্থ কথায় পরিণত করতে হলে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব ধরনের অপরাধ থেকে দেশ-জাতি ও মানবতাকে বাঁচাতে হলে, নৈতিক শিক্ষাকে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরে সবার জন্য আবশ্যক করতে হবে। তবেই দেশ ও জাতি পাবে সন্ত্রাস, দুর্নীতিসহ যাবতীয় অপরাধমুক্ত একটি মানব সমাজ। কারণ আজকের শিক্ষার্থীরাই হবে আগামীকালের অভিভাবক, সমাজপতি ও দেশনায়ক। বাস্তবায়িত হবে আল্লাহর বাণী ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারকে আগুন থেকে বাঁচাও।’ (সুরা আত্তাহরিম : ৬)। যেহেতু ধর্মই হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার মূলভিত্তি, সেহেতু বিভিন্ন ধর্মাবলাম্বীর জন্য তাই প্রযোজ্য হবে, যা তার ধর্মাদর্শ অনুমোদন করে। ধর্মাদর্শই হবে প্রত্যেকের নৈতিকতার মূলমন্ত্র।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়্যারম্যান

ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, এশিয়ান

ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত