সভ্যতা-সংস্কৃতি ও আধুনিকতা

মুহাম্মদ আসাদ উল্লাহ আদিল

প্রকাশ : ০১ মার্চ ২০২১, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.) এর পৃথিবীতে আগমনের মাধ্যমে মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন হয়। সব নবী ও রাসুল উৎকৃষ্ট সভ্যতার প্রকৃষ্ট বাহক। সবাই তিনটি প্রশ্নের মিশন নিয়ে তাদের নবুয়ত ও রিসালাতের দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর ছিলেন। আমাকে কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? কে সৃষ্টি করেছেন? আমার চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায়? এ তিনটি প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গিয়ে পৃথিবীর প্রতিথযশা দার্শনিক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষকরা আজ হয়রান। কেউ কেউ নিজস্ব চিন্তা-গবেষণা, ঐশীগ্রন্থ, সৃষ্টিজগতের বিশাল অস্তিত্বের মাধ্যমে প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধান খুঁজে পেয়ে হয়েছেন বিশ্বাসী। আবার কেউ কেউ চিন্তার বিকৃতি, অতিপ্রাকৃতিক দর্শন (Metaphysical Philosophy), সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাসহীনতার কারণে প্রশ্নগুলোর ভিন্ন সমাধান পেশ করে হয়েছেন নাস্তিক।

মানবসভ্যতার (Human Civili“ation) আলোচনা-পর্যালোচনার মধ্যে লাখ লাখ পৃষ্ঠার ইতিহাস নিহিত রয়েছে। সভ্যতার পরিচায়ক হলো সংস্কৃতি, যেমনিভাবে ফল বৃক্ষের পরিচায়ক। মনের বিকাশের নাম সংস্কৃতি, মস্তিষ্কের বিকাশের নাম সভ্যতা। যেমন ‘বিবাহ’ একটি সভ্যতা, আর বিবাহের নিয়মনীতি ও কার্যপ্রণালী সংস্কৃতি মাত্র। সভ্যতার বাহক হলো সমাজ, আর সংস্কৃতির বাহক মানুষ। যুগে যুগে সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মানুষের চিন্তাচেতনা, ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশ ও পার্থিব সুযোগ-সুবিধা, উপায়-উপকরণের কারণে সভ্যতা-সংস্কৃতির তারতম্য সৃষ্টি হয়। কারণ Civili“ation is what we use and culture is what we are. সংস্কৃতিকে যদি আরেকটু সহজ করে ব্যাখ্যা করি, Culture is the reflection of our mind অর্থাৎ আমাদের মনের চিন্তার প্রতিচ্ছবি তথা বহিঃপ্রকাশই হলো সংস্কৃতি। এক একটি জাতি এক একটি সভ্যতা বহন করে, কিন্তু স্থান-কাল ও রুচিবোধের কারণে সংস্কৃতির পার্থক্য ঘটতে পারে।

সভ্যতা ও সংস্কৃতি যুগ পরিক্রমায় আধুনিকতার রূপ লাভ করেছে। যদিও আমরা উত্তর আধুনিক কালে বাস করছি; মুসলিম সভ্যতা; কিন্তু কখনোই সেকেলে ছিল না। যদিও ঝড় পধষষবফ সড়ফবৎহ পরারষরুধঃরড়হ এর দৃষ্টিতে ইউরোপে রেনেসাঁর পূর্ববর্তী সময়কে অন্ধকার যুগ বলা হচ্ছে। অথচ আমরা যদি প্রাচীন মুসলিম সভ্যতা ও অমুসলিম সভ্যতার পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায় বর্তমান ইংল্যান্ড সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর পরও ছিল একটি অনুন্নত ও নিঃস্ব দেশ, সর্বত্রই ছিল মূর্খতা ও বর্বরতা, সমগ্র ভূখ- ছিল গভীর বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। অনেকে গৃহপালিত পশুও তাদের সঙ্গে শয়নকক্ষেই রাখত। ঠিক সে সময়ে মুসলিম বিশ্বের বড় বড় শহর বাগদাদ, দামেশক, কর্ডোভা, গ্রানাডার সভ্যতা-সংস্কৃতি অনেক বেশি উন্নত ছিল। ইউরোপিয়ানরা যখন বিল্ডিং তৈরি করতে জানতো না, সে সময়ে শুধু কর্ডোভাতে ৮০ হাজার পাকা বাড়ি ছিল, শহরের সব নাগরিক ছিল শিক্ষিত, হাসপাতালের সংখ্যা ছিল ৫০টি, মসজিদ ছিল ৮০টি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে (perspective) যদি সভ্যতা ও সংস্কৃতির আলোচনা করা হয়, তাহলে আমরা বলতে পারি, দীর্ঘদিনের লালিত সাহিত্য-সংস্কৃতি, গ্রামীণ ঐতিহ্য, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা, বিশ্বাস ও আস্থা, লোকশিল্প, মরমী, লোকগীতি, কুটিরশিল্প, কৃষি, ধর্ম ও দর্শন, সৌহার্দ্য ও সহায়তা এবং ভাষার গৌরবোজ্জ্বল অতীত রয়েছে। সবকিছু মিলে যদিও আমাদের একটি সভ্যতা, কিন্তু ধর্ম ও স্থানের তারতম্যের দিক থেকে আমাদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। একজন মুসলিম ও একজন অমুসলিম ব্যক্তির সংস্কৃতি কখনও এক হতে পারে না, তবে সে ভিন্নতার মাঝেও অবশ্যই রুচিশীলতা থাকতে হবে।

একজন মুসলিম যুবকের সংস্কৃতি আবর্তিত হয় তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাতকে ঘিরে। ভোরে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের ধ্বনি দিয়ে যে মুসলিম সংস্কৃতি শুরু হয় তার পরিসমাপ্তি ঘটে এশার আজানের সুললিত ধ্বনিতে। তার মানে একত্ববাদের ঘোষণা, রিসালাতের শিক্ষা অনুসরণের মাধ্যমে হাশরের ময়দানে সফল একজন মানুষ হওয়ার প্রত্যাশায় দিবানিশি অতিবাহিত হয়। প্রতিমুহূর্ত যার ব্যয় হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে। ‘নিশ্চয় খোদাভীরুদের জন্য রয়েছে চূড়ান্ত সফলতা’ (সুরা নাবা-৩১)। কিন্তু আজ সব কিছুতে আমরা বড়ই অমিল খুঁজে পাচ্ছি। সভ্যতার নামে অসভ্যতার প্রচলন, সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির লালন, পরিবার প্রথার ক্রমশ বিলোপ সাধন, আধুনিকতার নামে পোশাক-পরিচ্ছদের জীর্ণতা, খাওয়া-দাওয়ায় রুচির পরিবর্তনশীলতা, বিনোদনের নামে বেহায়াপনা ও অশ্লীলতা, স্মার্টনেসের নামে অপচয়, অপ্রয়োজনীয় স্মার্টফোনের ব্যাপক সয়লাব, রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন, অর্থের প্রতি সীমাহীন লোভ ও সামান্য অজুহাতে হত্যাকা- এ জাতির মধ্যে নতুন সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে।

প্রাচীন সভ্যতা ও ঝড় পধষষবফ আধুনিকতার মধ্যে আমরা কেমন জানি সুন্দর একটি মিল খুঁজে পাই। প্রাচীন যুগে পোশাক-পরিচ্ছদের স্বল্পতা ও বুনন শিল্পের জ্ঞানের অভাবে মানুষ গাছের ছাল, বাকল, পাতা, বিভিন্ন পশুর চামড়া দিয়ে শরীর ঢাকতো কখনও বা অনাবৃতই থাকত। ঠিক অনুরূপ আধুনিকতার উৎকর্ষতার যুগে মানুষ টাকা দিয়ে ছেড়া কাপড় কিনছে, পাশাপাশি অনাবৃত শরীর উপস্থাপনকে আধুনিকতার ফ্যাশন মনে করছে। সেকালে মানুষ রন্ধনপ্রণালী না জানার কারণে আগুনে পুড়িয়ে খেত, অনুরূপভাবে আমরা ঋরৎংঃ ভড়ড়ফ -এর নামে আগুনে পুড়িয়ে কাবাব ও গ্রিল খেয়ে নিজেদের মধ্যে আধুনিকতার ভাব সৃষ্টির চেষ্টা করছি। ইসলামি সংস্কৃতির পোশাকের পরিচায়ক পাঞ্জাবী-পাজামার মধ্যে ছেড়া ও ছিদ্র থাকলে পরিধানকারী ব্যক্তিকে দরিদ্র ও সেকেলে মনে করছি, ঠিক এর বিপরীতে জিন্সের প্যান্ট ও শার্টে পরিকল্পিত ছেড়া ও ছিদ্র থাকলে সেটাকে আমরা বড় লোকের লক্ষণ ও স্মার্টনেস ভাবছি। হলিউড, বলিউডের নায়ক-নায়িকা ও বিদেশি খেলোয়াড়দের পোশাক-পরিচ্ছদ ও রকমারি চুলের কাটিং এর অনুকরণ আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। ভিনদেশী চুলের কাটিং, কানে ইয়ারফোন, হাতে স্মার্টফোন, দু’হাতে বেসলেট, পরনে রুচিহীন কাপড়-চোপড় ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ একজন মানুষকে রোবটের মতো যান্ত্রিক মানুষে পরিণত করেছে। মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করা বড় দায়।

বিশেষ কোনো উপায়ে শরীরে ট্যাটু করা, রঙ মাখা ও অপরকে রঙ মারার সংস্কৃতি, হাই ভলিউম ডেকসেটের তালে তালে উন্মাত্ততার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া, একাধিক Girl friend I Boy friend রাখা, Multi-connection love এ দেশের জন্য আগামী দিনের বড় হুমকি। Eve-teasing-Gi cvkvcvwk Adam-tempting আজ নিয়মিত চিত্র।

ইসলামি শিক্ষার বিপরীত প্রতিটি কাজ আমাদের কাছে আজ আধুনিকতা। ইসলামের শিক্ষা হলো মিতব্যয়ী হওয়া, হাত-পায়ের নখ ছোট রাখা, দাঁড়ি রাখা, গোফ ছোট করা, রুচিশীল চুল রাখা, গোড়ালির নিচে কাপড় না ঝুলানো, ঢিলেঢালা পোশাক পরা, নারী-পুরুষ একে অপরকে পর্দা করা ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে খাওয়া-দাওয়াতে বিনোদনের নামে অপচয়, লম্বা নখ রাখা, দাড়ি না রাখা, গোঁফ লম্বা রাখা, বিভিন্ন কাটিং এ চুল রাখা ও কালারিং করা, গোড়ালির নিচে প্যান্ট ঝুলিয়ে দেওয়া, স্কিন টাইট কাপড় পরা, পর্দার পরিবর্তে খরাব ঃড়মবঃযবৎ ও অবাধ মেলামেশা, সাজসজ্জার নামে ভ্রু প্লাক (ইৎড়ি ঢ়ষঁপশ) করা চরম আধুনিকতার পরম নমুনা।

কোরআন-হাদীসের শিক্ষার বিপরীত জীবনযাপন করাই আজ আধুনিকতা ও প্রগতি। অথচ ইসলাম সর্বদা আধুনিক। মায়ের পেটে সন্তানের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে কাফন-দাফন পর্যন্ত একজন মানুষের সব সমস্যার সমাধান ও সব দিক-নির্দেশনা ইসলাম দিয়েছে। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত যুবকের মধ্যে যে বিশাল তফাৎ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণ দু’জনকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির হাজারও পচা গলি পথে পা বাড়াচ্ছে আমাদের দেশের লক্ষ কোটি যুবক, ভুলে গেছে নিজের মূল্যবোধ ও স্বকীয়তা, গ্রহণ করেছে ভিনদেশী অশ্লীলতা, অথচ সে বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধঃপতন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আল্লামা ইকবালের ভবিষ্যৎ বাণী এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য

হে পাশ্চাত্যবাসী!

আল্লাহর পৃথিবী একটি দোকানঘর নয়।

আর তোমরা যাকে সত্যিকারের স্বর্ণমুদ্রা মনে করেছ

তা মেকি বলে প্রমাণিত হবে।

তোমাদের নিজেদের উদ্যত খঞ্জরের উপরই

আপতিত হবে তোমাদের সভ্যতা।

ভঙ্গুর বৃক্ষ শাখায় নির্মিত কুলায়

ভেঙে পড়বে আজ নয় আগামীকাল।

কখনও এ স্থায়ী হওয়ার নয়॥

আমরা এমন এক যুগে এসে পড়েছি, যে যুগে সভ্যতার প্রগতি ও দুর্গতি একই সঙ্গে চলছে। বিজ্ঞানের সৃষ্টিশীলতা ও উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে এর ধ্বংসগামিতাও অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মানুষের অপরিসীম সম্ভাবনা ও মুক্তির ভাবনার সঙ্গে মানবিকতার সঙ্কট অনিবার্য হয়ে ওঠেছে। কথিত আধুনিকতা যেমন মানুষকে স্বেচ্ছাচারী করেছে, তেমনি করেছে নির্বাসিত। Isolation, Alienation I Aggression এখন আধুনিকতার কাঁধে সওয়ার।

মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে সরানোর জন্য অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ম্যাকানিজম চলছে। নাটক, সংলাপ, শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, পরনের পরিচ্ছদ প্রভৃতিতে ভিনদেশী সংস্কৃতির আমদানি ঘটিয়ে যুবসমাজের সঠিক ও সুষ্ঠু চিন্তাধারায় ব্যাঘাত ঘটানো হচ্ছে। যে উম্মাহর সৃষ্টি পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে তারাই আজ পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ। ইহুদিরা পরিকল্পিতভাবে পুরো পৃথিবীর মানুষগুলোকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার দুটি গোলকে আবদ্ধ রেখে তারা আজ পৃথিবী নামক গোলক নিয়ে খেলছে। তাই আধুনিকতার নামে হতাশাগ্রস্ত এ আত্মপরিচয়ভোলা জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেওয়ার জন্য দরকার নিরলস পরিশ্রমী, নিঃস্বার্থ, মানবতাবাদী, সাহসী, পড়–য়া, জ্ঞানী, মার্জিত, রুচিশীল, সৎ, দক্ষ ও নেতৃত্বের গুণাবলী সম্পন্ন একদল যুবকের, যাদের কাজ হবে পুরো উম্মাহ্কে কোরআনের প্রথম অহি ‘পড়! তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, সিজদা কর ও নৈকট্য অর্জন কর’ (সূরা আলাক্ব : ১, ১৯)। পড়া ও জানা, জানার মাধ্যমে মানা, মানার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য অর্জনে সিজদায় অবনত হওয়ার শিক্ষায় শিক্ষিত ও দীক্ষিত করে নিজেদের গড়ে তোলে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সুস্থ সংস্কৃতি সম্পন্ন ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা।

গবেষক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া