আজ জমজম কূপ সম্পর্কে একটি অজানা তথ্য আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে চাই। নবী করিম (সা.) এক হাদিসে এরশাদ করেছেন, ‘আনা ইবনুয যাবিহাইন’ আমি দুই কোরবানির পুত্র। এক কোরবানি তো ইবরাহিম (আ.) এর পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)। তাকে কীভাবে ইবরাহিম (আ.) কোরবানি করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তা আমরা জানি। তার অনুসরণে সামনে কোরবানির ঈদে ইনশাআল্লাহ আল্লাহর তৌফিক অনুযায়ী আমরা কোরবানি করব। হজরত ইসমাইল (আ.) এর বংশেরই সন্তান ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)। আরেক কোরবানি তাহলে কে? সে অজানা তথ্যটির দিকে আমি খুব সংক্ষেপে আলোকপাত করব। বিস্তারিত আলোচনায় যাব না। তথ্যভিত্তিক সে আলোচনা আমি অন্যত্র করেছি। গত বছর করোনার সময় গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় একটি পুস্তিকা রচনা করেছি আল্লাহর রহমতে। নাম দিয়েছি কোরবানির ইতিহাস। তাতে হজরত আদম (আ.) এর ছেলে হাবিল-কাবিলের কোরবানি, ইবরাহিম (আ.) এর কোরবানি, সুরা বাকারায় বর্ণিত বনি ইসরাইলের গাভি কোরবানি এবং নবীজির আব্বাজান হজরত আবদুল্লাহর কোরবানি নিয়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনা করা সম্ভব হয়েছে। সঙ্গে আছে রাজা গৌরগোবিন্দের আমলে এক মুসলমানের গরু কোরবানির জেরে হজরত শাহজালাল (রহ.) এর সিলেট জয়ের ইতিহাস এবং মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম শহিদের সময়কার কোরবানির ইতিহাসের ওপর আলোকপাত। অবশ্য বইটি এখনও ছাপানোর সামর্থ্য হয়নি।
সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও প্রসার হয়েছে কোরবানির চেতনায়। এ জন্যই এ দেশের ঘরে ঘরে কোরবানি উপলক্ষে গরু জাবাইয়ের উৎসব হয়। যতদিন এই উৎসব থাকবে, ততদিন এ দেশে ইসলামের বিজয় চেতনা অক্ষুণœ থাকবে ইনশাল্লাহ।
এখন নবী করিম (সা.) এর পিতা হজরত আবদুল্লাহ কীভাবে দ্বিতীয় কোরবানি ছিলেন, সে ইতিহাসের ওপর আলোকপাত করতে চাই। জমজম কূপ খনন হয়েছিল হজরত ইসমাইল (আ.) এর শৈশবকালে অলৌকিকভাবে। কালের দুর্বিপাকে কাবাঘর বিধ্বস্ত হওয়ার মতো জমজম কূপও ভরাট হয়ে গিয়েছিল এবং তার কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল না। এই কূপ পুনঃআবিষ্কার হয়েছিল হজরত নবী করিম (সা.) এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের মাধ্যমে। স্বপ্নে তাকে আদেশ করা হয়Ñ কাবাঘরের পাশে মাটির টিবির ওপর, যেখানে লাল পিপড়ার বাসা এবং লাল পা ও চঞ্চু বিশিষ্ট কাকেরা ওড়াওড়ি করে, সেখানে খনন করÑ জমজম পেয়ে যাবে। পরপর তিন দিন এই স্বপ্ন দেখার পর তিনি খননকার্য শুরু করেন। কুরাইশদের বাধা উপেক্ষা করে তিনি ছেলে হারেসকে সঙ্গে নিয়ে খননকার্য চালান এবং জমজম পেয়ে যান।
কুরাইশদের প্রবল বাধার সময় তিনি মানত করেন, যদি তিনি জমজম খুঁজে পান আর তার জনবল বৃদ্ধি পায়, ছেলে সন্তান ১০ জন হয়, তাহলে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দেবেন। মানত পালনের জন্য একদিন তিনি সবচেয়ে প্রিয় সন্তান আবদুল্লাহকে কোরবানি দেওয়ার জন্য বের হন। তাতে পরিবারের সদস্যরা প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলেন, ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে ইসমাইলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি দিয়েছিলেন। আপনিও তেমনটি করেন। কিন্তু কোরবানির ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম তিনি কীভাবে জানবেন। সবার পরামর্শে কয়েকজন মিলে মক্কার অদূরে এক পুরোহিতের কাছে গিয়ে সিদ্ধান্ত চাইলেন। পুরোহিত জানতে চাইলেন, আপনাদের দেশে কোনো মানুষকে হত্যা করা হলে হত্যার বদলায় রক্তপণ দেওয়ার হিসাব কী। তাকে বলা হলো, ১০টি উট। তিনি বললেন, কাবাঘরে রক্ষিত লটারির তিরের ফলা দিয়ে লটারি করবেন, একটি ফলায় আবদুল্লাহ নাম লিখবেন। আরেকটির গায়ে ১০টি উটের সংখ্যা লিখবেন। লটারিতে যদি উটের নাম আসে, তাহলে আবদুল্লাহ বদলায় ১০টি উট কোরবানি দেবেন। আর যদি আবারও আবদুল্লাহর নাম আসে, তাহলে আরও ১০টি সংখ্যা যোগ করে লটারি দেবেন। যদি তাতেও আবদুল্লাহর নাম আসে ২০টির স্থলে ৩০টি লিখবেন। এভাবে প্রতিবার লটারিতে ১০টি করে উটের সংখ্যা বাড়াতে থাকবে, যতক্ষণ আবদুল্লাহর নাম না আসে। এভাবে ১০০টি উট লেখার পরই লটারিতে আবদুল্লাহর পরিবর্তে উটের নাম ওঠে। আবদুল মুত্তালিব বললেন, তাতে হবে না। অন্তত তিনিবার লটারি দিয়ে জানতে হবে, আবদুল্লাহর পরিবর্তে উটের নাম আসে কি-না। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। আবদুল মুত্তালিব ১০০টি উট কোরবানির সম্পূর্ণ গোশত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। নিজের ও পরিবারের জন্য এর কিছু অংশও নিলেন না। এই হলো নবী করিম (সা.) দ্বিতীয় কোরবানির সন্তান হওয়ার তথ্য।
এই আলোচনা এবং ঐতিহাসিক তথ্যগুলো প্রমাণ করে, ইসলাম ও মুসলমানরা বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ও প্রামাণ্য সভ্যতা সংস্কৃতির ধারকবাহক। অন্যান্য ধর্মের ইতিহাস খোঁজ করলে আপনি দেবলীলা জাতীয় কল্পকাহিনি ছাড়া এ জাতীয় কোনো সত্য তথ্য পাবেন না। খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মের ইতিহাসও দাঁড় করানো হয় কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত তথ্যাদি সামনে রেখে। কারণ মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির কাছে অক্ষত-অবিকৃত ইতিহাস বিদ্যমান নেই। ইতিহাস হলো গাছের শিকড়ের মতো। যে গাছের শিকড় যত গভীর ও সমৃদ্ধ, ঝড়ঝাপটার মোকাবিলায়, সে গাছ ততখানি অবিচল। শিকড় শক্ত না থাকলে সামান্য টানে বা বাণে বাতাসে মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রেও এই উপমা পুরোপুরি সত্য। যে জাতির ইতিহাস যত সমৃদ্ধ বিশ্বের দরবারে, সে জাতির মর্যাদা তত উচ্চ। এ জন্যই ইতিহাস গবেষণায় বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোগের শেষ নেই। জাদুঘর বা প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণা ও খননকার্যের পেছনে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ের রহস্যও এখানেই নিহিত।
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আবরাহা বাদশাহ কাবাগৃহ ধ্বংস করতে এলে আবাবিল পাখির আক্রমণে ধ্বংস ও নিপাত যায়। পরবর্তী সময়ে এজিদ ও হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের আক্রমণের সময় কেন এ ধরনের অলৌকিক কিছু ঘটেনি। একেবারে ঘটেনি তা নয়, বিস্তারিত ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যাবে যে, যুদ্ধরত সৈন্যদের ওপর বজ্রাপাত হয়েছিল। এসব হামলার নায়করা ইতিহাসে ধিকৃত ও ঘৃণিত, এটিও কম কী? সবচেয়ে বড় কথা, যারা আক্রমণ করেছিল, তাদের কারও উদ্দেশ্য কাবাঘর ধ্বংস করা ছিল না। বরং কাবাঘরে আশ্রিত হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরের প্রতিই তাদের আক্রোশ ছিল। তার প্রমাণ হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের মতো রক্তপিপাসু স্বৈরশাসকও কাবাঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল। ইতিহাসের এই ভাঙাগড়া ইসলামের সত্যতার বড় সাক্ষী। অন্য কোনো জাতির জীবনে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সেই জাতি বা মতাদর্শের অস্তিত্ব থাকত না। কিন্তু ইসলাম প্রতিটি বিপর্যয় মোকাবিলা করে নিজস্ব আদর্শিক শক্তিতে আবার উন্নত শিরে দাঁড়িয়েছে। কবির ভাষায় এ সত্যই ব্যক্ত হয়েছে : ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বাদ।’
(ঢাকার বায়তুশ শরফ মসজিদে ২ জুলাই ২০২১, শুক্রবার জুমার খুতবা-পূর্ব
আলোচনা থেকে)