ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনোরূপ সহিংসতা ও বিবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়, এমন আচরণকে ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। সর্বক্ষেত্রে শান্তির বিধান নিশ্চিত করে প্রেম-প্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক মাহাত্ম্যপূর্ণ বিধান বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠা করাই মহানবী (সা.) এর মূল লক্ষ্য ছিল। সর্বযুগের, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) সেই অসাধারণ গুণাবলিরই অধিকারী, যার মধ্যে সীমার মধ্যে থেকেও অসীমের সান্নিধ্য উপলব্ধি করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। ইতিহাসের আলোকে তিনি এক ক্ষণজন্মা, মহান কর্মতৎপর, দূরদ্রষ্টা মহাপুরুষ হিসেবে নন্দিত। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় ও হৃদয় গভীরে বরণীয়। তার আদর্শ অনুসরণে সমগ্র সৃষ্টিজগতের শান্তি, কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত। আর এই শান্তিময় পৃথিবীতে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সম্পর্কে সতর্ক বার্তা দেওয়া হয়েছে। মানুষের প্রাণহানি ঘটানোকে বলা হয়েছে পুরো মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে গণ্য করা হয়েছে হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ হিসেবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ফেতনা-ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।’ (সুরা বাকারা-১৯১)।
মানব ইতিহাসে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ এক বিরল ঘটনা। এসব ঘটনায় মহানবীর ঔদার্য ও মহত্ত্ব, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা, বহুমুখী প্রতিভা প্রকাশমান। এমন মনীষীকে পেয়ে বিশ্ব যেন আপন অস্তিত্বকে ফিরে পেল। স্বভাবতই বিশ্ব মনীষায় তার অবস্থান সবার ঊর্ধ্বে, শীর্ষ দেশে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তার কোনো জুড়ি নেই।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বরূপ
অমুসলিমের প্রতি কোনো অন্যায়-আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় মহানবী (সা.) এর রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন-ধর্মাবলম্বীদের প্রতি মহানবী (সা.) এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক অমুসলিম বৃদ্ধার ঘটনা ইতিহাসে আমরা জেনেছি। বৃদ্ধা প্রতিদিন মহানবী (সা.) এর চলার পথে কাঁটা দিত। একদিন রাসুল (সা.) দেখলেন পথে কাঁটা নেই। তখন তিনি ভাবলেন, হয়তো ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়েছে বা কোনো বিপদে আছে, তার খোঁজ নেওয়া দরকার। এরপর দয়াল নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দেখেন ঠিকই সে অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। এতে বৃদ্ধা অভিভূত হয়ে গেল যে, আমি যাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য পথে কাঁটা পুতে রাখতাম। তিনি আজ আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইনিই তো সত্যিকার অর্থে শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত।
রাসুল (সা.) এর ঘরে একবার এক ইহুদি মেহমান হয়ে এলে রাসুল (সা.) তাকে যথাযথ মেহমানদারি করলেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে সে ইহুদি মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে। তাই রাসুল (সা.) তাকে কিছু বলবেন এই ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে গেল। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসুল (সা.) এই মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে, হায়! আমি হয়তো ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারি করতে পারিনি; এতে সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানাটি পরিষ্কার করলেন। আর সেই ব্যক্তির কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন এভাবে যে, ‘ভাই আমি আপনার যথাযথ মেহমানদারি করতে পারিনি, এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ! অতঃপর রাসুল (সা.) এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর এই উদারতা ও ঐতিহাসিক চরিত্রকে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে- ‘তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছো সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে’।
মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর যে মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, তা বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি ও সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সব ধর্ম সম্প্রদায়ের নিজ নিজ ধর্মকর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনোরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে, কোনো নাগরিক কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। (সিরাতে ইবনে হিশাম)।
কোনো মুসলিম যদি কোনো অমুসলিমের প্রতি অন্যায় করে, তবে রোজ-কেয়ামতে মহানবী (সা.) তার বিপক্ষে লড়বেন বলে হাদিসে এসেছে। রাসুল (সা.) বলেন, সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে তার অধিকার খর্ব করে, তার ক্ষমতার বাইরে কষ্ট দেয় এবং তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক নিয়ে যায়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি তার পক্ষে আল্লাহর দরবারে অভিযোগ উত্থাপন করব। (আবু দাউদ : ৩০৫২)। এভাবে ঐতিহাসিক মদিনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী (সা.) ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্যমৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন।
রাসুল (সা.) বিশ্ববাসীর সামনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই যে নজির রেখেছেন তা যেমন বিশ্বজনীন, তেমনি কেয়ামত অবধি সর্বকাল ও সর্বসময়ের জন্য তা প্রযোজ্য। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী (সা.) বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশ করে খানায়ে কাবায় চৌকাঠে হাত রেখে দাঁড়ালেন, তখন তাঁর সামনে ছিল অতীতের সব জঘন্য অপরাধ নিয়ে অবনত মস্তকে মক্কাবাসী। তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। চারপাশ ঘিরে নির্দেশের অপেক্ষায় তীক্ষè তরবারি হাতে মুসলিম সেনাদল। সেদিন মহানবী (সা.) বলতে পারতেন, ‘ওদের গর্দান উড়িয়ে দাও। আর যে হাত শান্তিকামী তৌহিদবাদীদের ওপর নিষ্ঠুর-নির্যাতন চালিয়েছিল, ওই হাত ভেঙে দাও। যে চোখগুলো অসহায় মুসলিমের দিকে হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে তাকাত, সে চোখগুলো উপড়ে ফেলে দাও। তিনি ঘোষণা করতে পারতেন, আজ থেকে কোরাইশ পুরুষরা বিজয়ী মুসলিম বাহিনীর গোলাম। আর নারীরা দাসী হিসেবে গণ্য হবে।’ কিন্তু মহানবী (সা.) তেমন কিছুই বলেননি; বরং তিনি শত্রু সম্প্রদায়ের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি তাদের বলেছেন, হে কুরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করো? তারা বলল, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, আমি তোমাদের সঙ্গে সেই কথাই বলছি, যে কথা হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- আজ তোমাদের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, তোমরা সবাই মুক্ত। প্রতিশোধের পরিবর্তে শত্রুদের প্রতি মহানবীর ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জানান দেয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় জন্য মহানবী (সা.) এতই সোচ্চার যে, রাসুল (সা.) নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ একাধিক স্থানে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার তুলে ধরা হয়েছে। অমুসলিমরা নিজ নিজ উপাসনালয়ে-উপাসনা করবেন। নিজ ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মালয়কে সুরক্ষিত রাখবেন। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাদের সমান অধিকার রয়েছে। তাদের প্রতি কোনো ধরনের বৈষম্য ইসলাম সাপোর্ট করে না। আজও মহানবী (সা.) এর কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বে শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কবি ইকবালের ভাষায়- ভ্রাতৃত্বের বিশ্ব ব্যাপকতা প্রেম প্রাচুর্য/এই হলো মুসলমানের মূলতত্ত্ব;/রক্ত ও বর্ণবিচূর্ণ করো,/আত্মবিলাপ করো মুসলিম মিল্লাতের মাঝে,/তোমার পরিচয় হবে না কাজ আছে ইরানি, তুরানি, আফগানি বলে। কোনো ধর্মের প্রতি সামান্য কটূক্তিও না করার জন্য কোরআনে আল্লাহপাক নির্দেশ দিয়েছেন- ‘তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। কেননা, তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞানবশত আল্লাহকে গালি দেবে।’ (সুরা আন’আম-১০৮)।
পরিশেষে বলা যায় যে, মহানবী (সা.) এর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসংখ্য-অগণিত উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, শান্তি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ও সদ্ব্যবহার মহানবীর অনুপম শিক্ষা। কোনো সংকীর্ণতা হিংসা-বিদ্বেষ নয়; বরং উদার-মহানুভবতাই হচ্ছে, মহানবীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশ্বনবী (সা.) বিশ্বে শান্তির অমোঘ বাণী নিয়েই এসেছিলেন। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম, সংঘাত-সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িকতাকে চরমভাবে ঘৃণা করে।
লেখক : শিক্ষার্থী
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়