১৯৫২ সাল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করল উর্দু হবে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তথা বাংলার দামাল ছেলেরা এই ঘোষণা মেনে নিতে পারেনি। শুরু করে আন্দোলন। এর পরের ঘটনা সবারই জানা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে দীর্ঘদিন যুদ্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠিত হয়। ৭১ এর ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণে অসহযোগ আন্দোলনের আভাস পাওয়া গেলেও প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার বীজ বহু আগেই বপিত হয়েছিল এই বাংলায়। তখন শুধু সঠিক সময়ে ফেঁপে উঠেছিল।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ছিল একটা সাধারণ ব্যাপার, যা জালেমণ্ডমজলুমের চিরন্তন দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা যায়। এই অর্জনের পেছনে সাধারণ স্বাধীনতার চেতনা ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। অর্থাৎ, এটা বিজয় হলেও বিপ্লব ছিল না। তাই চেতনার ফেরিওয়ালারা কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেনি। এমনকি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় খুব একটা তফাৎ নেই। আদতে বিপ্লব না হলে তফাৎ হওয়াটা অস্বাভাবিক।
গঙ্গার দক্ষিণ-পূর্ব মোহনায় অবস্থিত একটা বিশাল অঞ্চলকে বাঙ্গালা বা বাংলা বলা হয়। বাঙ্গালা নামটি মুসলিম আমলে প্রচলিত হয়। ইতিপূর্বে এই জনপদের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। যেমন-উত্তরবঙ্গ প্রথমে পু-্র, পরে বরেন্দ্র; পশ্চিমবঙ্গ প্রথমে সুম্ম, পরে রাঢ়; পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল বঙ্গ এবং মেঘনা-পূর্ববর্তী এলাকা সমতট নামে পরিচিত।
ভারতের এই পূর্ব জনপদের নাম ছিল গৌড়। মুসলিম বিজয়ের সময় এর নাম হয় লক্ষণাবতী। তাই ফার্সি ইতিহাসে এর নাম লখনৌতি হয়। খুব সম্ভব প্রাচীন গৌড় নগরের এ লক্ষণাবতী নামকরণ মহারাজা লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক করা হয়েছিল। রেভার্টির মতে রামানুজ লক্ষণের নামের সঙ্গে সংযুক্ত। যদিও এই অনুমানের কোনো ভিত্তি নেই।
সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ (৭৪০-৭৫৯/১৩৩৯-১৩৫৮) সর্বপ্রথম সমগ্র জনপদ একক শাসনাধীনে আনলে এর নাম হয় বাঙ্গালা এবং তিনি ‘শাহ-ই বাঙ্গালা’ ও ‘সুলতান-ই বাঙ্গালা’ উপাধি লাভ করেন। এরপর থেকে বাঙ্গালা নাম প্রচলিত হয়ে যায় এবং মোঘল আমলে সারা সাম্রাজ্য কয়েকটি সুবা বা প্রদেশে বিভক্ত হলে এই প্রদেশ সুবা বাঙ্গালা নাম ধারণ করে।
আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী গ্রন্থে বাঙ্গলা নামকরণের ব্যাপারে একটা বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লেখেন, ‘বাঙ্গলাদেশের নাম পূর্বে বঙ্গই ছিল, পরে আল শব্দ তাহাতে যুক্ত হয়। এই আল শব্দের অর্থ জল প্রতিরোধের বাঁধ। বঙ্গদেশে অনেক নিম্নভূমি আছে। সেখানে বাঁধ বা খাল বাঁধিতে হইত; সেই জন্য বঙ্গ শব্দের সহিত এই ‘আল’ শব্দের যোগ হইয়া বাঙ্গাল শব্দ নিষ্পণœ হইয়াছে। এই বাঙ্গাল শেষে বাঙ্গলাতে পরিণত হইয়াছে।’
ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন সলিম তার গ্রন্থ রিয়াযুস সালাতিনে বাঙালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে এক বিস্ময়কর তথ্য দেন। আর তা হলো, হজরত নুহ (আ.) এর পৌত্র বং (বঙ্গ) থেকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি হয়। কারণ নুহ (আ.) এর সময়ে মহাপ্লাবনের পর নুহ (আ.) এর নির্দেশে তার পুত্ররা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে। যে যে জায়গায় যায় সে জায়গা তার নামানুসারেই হয়। যেমন হজরত নুহ (আ.) এর বড় পুত্র হিন্দ হিন্দুস্তানে এলে তার নাম হয় হিন্দুস্তান। অন্য পুত্র সিন্ধ সিন্ধে এলে তার নামানুসারে এর নাম হয় সিন্ধু। ঠিক সে রকম নুহ (আ.) এর পৌত্র হিন্দ-এর পুত্র বঙ্গ বাংলায় এলে বঙ্গ থেকে বাংলা নামের উৎপত্তি হয়।
মূলত নুহ (আ.) এর ছয় পুত্রের মাধ্যমেই পৃথিবীর সব জাতির উৎপত্তি ঘটে। হজরত নুহ (আ.) এর ছয় পুত্র যথাক্রমে হিন্দ, সিন্ধ, হাবাশ, জানায, বার্বার, নিউবা। এর মধ্যে হিন্দের পুত্র বং (বঙ্গ) থেকে বাঙালি জাতির উৎপত্তি। হিন্দের আরেক পুত্র পুরবের পুত্র সংখ্যা ছিল ৪২। হিন্দের আরও দুই পুত্র দখিন ও নাহারওয়ানের থেকে উৎপত্তি ঘটে আরও জাতির। শুধু বং থেকেই সরাররি বাঙালি জাতির উৎপত্তি। বাকিদের ধারা বিস্তৃত।
গোলাম হোসেন সেলিম বলেন, ‘হিন্দের পুত্র বং (বঙ্গ) এর সন্তানরা বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। আদিতে বাংলার নাম ছিল বং। এর সঙ্গে ‘আল’ শব্দ যোগ হওয়ার কারণ হচ্ছে এই, বাংলা ভাষায় আল অর্থ বাঁধ। যাতে বন্যার পানি বাগানে অথবা আবাদি জমিতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য জমির চারদিকে বাঁধ দেওয়া হতো। প্রাচীনকালে বাংলার প্রধানেরা পাহাড়ের পাদদেশে নিচু জমিতে দশ হাত উঁচু, কুড়ি হাত চওড়া স্তূপ তৈরি করে তার ওপর বাড়ি, চাষাবাদ করতেন। লোকে এগুলোকে বলত বাঙালা।
তথ্যসূত্র :
১. বাংলার ইতিহাস- আবদুল করিম
২. আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী- আবুল ফজল
৩. History of The Muslims of Bengal - Muhammad Mohar Ali
৪. তবকাত-ই নাসিরী - মীনহাজ-ই সিরাজ
৫. বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতীন) গোলাম হোসেন সলিম, অনুবাদ আকবর উদ্দীন, ঢাকাণ্ড২০০৮।
৬. মুসলমানদের ইতিহাসচর্চা, পৃ. ১৬৪, মাহবুবুর রহমান।