কুয়াকাটায় বনভূমি বিলীন ঝুঁকিতে উপকূল
প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এমকে রানা, পটুয়াখালী

বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল কুয়াকাটা যেখানে একইসঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। এই অনন্য সৌন্দর্যের টানে দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন। কিন্তু পর্যটনের আড়ালে ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে কুয়াকাটার উপকূলীয় বনভূমি। একসময় সৈকতের দুই পাশজুড়ে বিস্তৃত ছিল ঝাউবন, যা আজ জায়গা করে দিচ্ছে হোটেল-মোটেল, দোকানপাট ও বসতবাড়িকে। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, এই বনায়ন ধ্বংস হলে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, উপকূলের মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের তথ্য বলছে, ২০০১-২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর বনভূমি হারিয়েছে, যা মোট বনাঞ্চলের প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে দক্ষিণ উপকূলের জেলাগুলোতে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কুয়াকাটা ইকোপার্কের আয়তন ৫ হাজার ৬৬১ হেক্টর এবং কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ৬১৩ হেক্টর। কিন্তু বাস্তবে সুরক্ষিত এই এলাকাগুলোও দখল, অব্যবস্থাপনা ও ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গাছপালা হারিয়েছে। স্থানীয় জেলে আনোয়ার মাঝি বলেন, আগে ঝড় এলে আমরা ঝাউবনের ভেতরে আশ্রয় নিতাম। ঝাউবন আমাদের প্রাকৃতিক ঢাল ছিল। এখন সেই বনের জায়গায় হোটেল হয়েছে। সামান্য ঝড়েই ঘরবাড়ি উড়ে যায়। কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, বন না থাকায় লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। আগের মতো ধান হয় না। গরমও অনেক বেড়ে গেছে।
হোটেল শ্রমিক রুবেল হাওলাদার বলেন, হোটেল তৈরি হচ্ছে বলে কাজ পাচ্ছি। কিন্তু বন ধ্বংস হলে পর্যটকও আসবে না, তখন কাজও থাকবে না। গৃহিণী লতিফা বেগম বলেন, আমাদের ছোটবেলায় সৈকতের পাশে বিশাল ঝাউবন ছিল। এখন বাচ্চাদের দেখানোর মতো কিছু নাই। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. মো. হুমায়ুন কবির বলেন, উপকূলীয় বন শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, এটি প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বলয়। বন ধ্বংস হলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি বহুগুণ বেড়ে যাবে। পাশাপাশি কচ্ছপ, পাখি, হরিণসহ নানা প্রাণীর জীবনচক্র ধ্বংস হবে।
জাতীয় পরিবেশ আন্দোলনের নেতাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন , দক্ষিণ উপকূলের বনকে যদি এখনই রক্ষা করা না যায়, তবে এটি শুধু স্থানীয় সমস্যা থাকবে না; পুরো দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে হোটেল-মোটেল নির্মাণে বনভূমি কেটে ফেলা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে জ্বালানি কাঠ ও ব্যবসার জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা হচ্ছে। সিডর, আইলা, বুলবুল, মোরা ও সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার গাছ ধ্বংস হয়েছে। সরকারিভাবে বনায়ন হলেও নিয়মিত পরিচর্যার অভাবে চারাগাছ বাঁচে না।
বনভূমি কমে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকায় বনভূমি হারানোর প্রভাব প্রাণীকূলের ওপরও পড়ছে। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থান কমে গেছে। শীতে আসা পরিযায়ী পাখির সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
শেয়াল, হরিণ, খরগোশসহ ছোট প্রাণীর আবাসস্থল বিলীন হচ্ছে। খাল-বিল ভরাট হয়ে মাছ, কাঁকড়া ও শামুকের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে স্থানীয় শিক্ষক আব্দুল হালিম বলেন, আমরা শৈশবে আকাশভরা পাখি দেখতাম। এখন ছাত্রদের দেখানোর মতো কিছু নাই। জীববৈচিত্র্য শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই বনভূমি হারিয়ে শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের জীবনেও এসেছে বড় পরিবর্তন। ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ খোলা আকাশের নিচে অসহায় হয়ে পড়ছে। কৃষিজমিতে লবণাক্ততা ও মাটিক্ষয় বেড়েছে। গরম বেড়ে গিয়ে দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়ে পর্যটন খাত সংকটে পড়ছে।
এ বিষয়ে বন বিভাগ জানিয়েছে, উপকূলীয় এলাকায় সামাজিক বনায়ন প্রকল্পসহ বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কুয়াকাটায় নতুন ঝাউসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, নজরদারি ও সঠিক পরিচর্যার অভাবে এসব প্রকল্প টেকসই হচ্ছে না।
একজন বন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা গাছ লাগাই, কিন্তু স্থানীয়দের সহযোগিতা না থাকলে সেগুলো টিকিয়ে রাখা যায় না। পরিবেশবিদদের মতে, বর্তমান ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যেই কুয়াকাটার প্রাকৃতিক বেষ্টনী প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এতে পর্যটন শিল্প ধ্বংস হবে, কৃষি উৎপাদন কমবে, জীববৈচিত্র্য বিলীন হবে এবং উপকূলীয় লাখো মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়বে। কুয়াকাটা শুধু একটি সমুদ্র সৈকত নয়; এটি দক্ষিণ উপকূলের মানুষের জীবনরক্ষাকারী প্রাকৃতিক ঢাল। বনভূমি হারালে সৌন্দর্যের পাশাপাশি বেড়ে যাবে দুর্যোগের ঝুঁকি, ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষি, অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন রক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু শুনবে একসময় কুয়াকাটা ছিল সবুজ ঝাউবনের দেশ।
