নওগাঁ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে প্যাডেল রিকশা

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আব্বাস আলী, নওগাঁ

কয়েক বছর আগেও নওগাঁ শহরের অলিগলিতে প্যাডেল রিকশার বেলের ক্রিং ক্রিং আর টুং টাং শব্দ শুনা যেত। ক্রিং ক্রিং বেলের শব্দে শহরবাসীর ঘুম ভাঙতো। তবে সময়ের সঙ্গে সেই প্যাডেল রিকশা এখন বিলীনের পথে। মানুষ এখন আর ঘাম ঝরাতে চাই না। শরীরে বাতাস লাগিয়ে শ্রম ও সময় বাঁচিয়ে বাড়তি আয় করতে চাই। প্যাডেল রিকশার পরিশ্রম বেশি কিন্তু সেই তুলনায় আয় কম। আর ব্যাটারিচালিত রিকশায় পরিশ্রম কম হলেও আয় বেশি। সে কারণে অল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় প্যাডেল চালিত রিকশা ছেড়ে চালকরা এখন ঝুঁকছেন অটো রিকশার দিকে। বেশির ভাগ সময় অলস বসে থাকতে হয়। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা বাড়ায় প্যাডেল রিকশা চালকদের এখন এমন করুণ দুর্দশা।

প্যাডেল রিকশা তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আগামী প্রজন্ম জানবে না প্যাডেল রিকশা কি। একসময় হয়ত স্থান পাবে জাদুঘরে। জেলায় প্রায় ৫০টি কারখানায় মাসে অন্তত ২৫০টির মতো রিকশা উৎপাদন হয়। যার উৎপাদন খরচ প্রায় ২ কোটি টাকা।

এক সময় অভ্যন্তরীণ যাতায়াতে প্যাডেল রিকশায় ছিল একমাত্র বাহন। তবে সময়ের সঙ্গে আজ ঐতিহ্য হারিয়েছে প্যাডেল রিকশা। এখন শোনা যায় না প্যাডেল রিকশার বেলের ক্রিং ক্রিং আর টুং টাং শব্দ। যার প্যাডেল ঘুরিয়ে চলত শতশত শ্রমজীবি মানুষের সংসার। তবে গত ৫ বছরের ব্যবধানে সে জায়গা দখল করেছে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা। গ্রাম থেকে শহর সবখানেই এখন অটোরিকশার দৌরাত্ম্য। হাজারও অটোরিকশার ভিড়ে শহরে এখন তিনটি প্যাডেল চালিত রিকশা চোখে পড়ে। এসব রিকশার চালক বয়স্ক ব্যক্তি। যাদের আয়েও পড়েছে ভাটা।

নওগাঁ শহরের খাস-নওগাঁর বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম। গত ৪ দশক থেকে প্যাডেল চালিত রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ২ বছর আগেও দিনে ২০০-৩০০ টাকা আয় করতেন। তবে যাত্রীরা এখন আর প্যাডেলের রিকশায় না উঠায় আয়েও ভাটা পড়েছে।

প্যাডেল রিকশার চালক সিরাজুল ইসলাম বলেন- মানুষ এখন আর রিকশায় উঠতে চায় না। এ জন্য বেশির ভাগ সময় অলস বসে থাকতে হয়। তারপরও দিনে ৮০-১০০ টাকা ভাড়া হয়। এ দিয়ে তো সংসার চলবে না। কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। অভাবের সংসারে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা কিনার সামর্থ্য না থাকায় প্যাডেলের রিকশায় ভরসা।

ব্যাটারিচালিত কারখানার মালিকরা জানান- গত ২ বছরে রড ও শিটের দাম বেড়েছে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ। ৬০-৬৫ টাকা কেজির রড এখন ৯০-৯৫ টাকা কেজি। এছাড়া ৯০ টাকা কেজির শিট বর্তমানে ১৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এতে প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশায় দাম বেড়েছে ১৫-২০ হাজার টাকা। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশা ফ্রেম বা বডি তৈরিতে খরচ পড়ে অন্তত ৮০ হাজার টাকা। যার বিক্রি মূল্য ৮৫-৯০ হাজার টাকা। আর ব্যাটারিসহ একটি অটোরিকশা খরচ প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

বাচারিগ্রাম সোনারপাড়ার অটোচালক মিঠু হোসেন বলেন- প্যাডেল রিকশায় শ্রম বেশি। মানুষ এখন আর কঠিন পরিশ্রম করতে চাই না। সকালে সংসারের কাজ করে অটোরিকশায় নিয়ে সারাদিনে অন্তত ৫০০-৭০০ টাকা আয় করা যায়। এছাড়া কিস্তি থেকেও অটো রিকশা কিনা যায়। আয়ের একটি অংশ দিয়ে কিস্তি পরিশোধ হয় এবং সংসারও চলে।

সদর উপজেলার উল্লাসপুর গ্রামের ব্যাটারিচালিত রিকশা কারিগর কুরবান আলী বলেন- প্রতিটি ব্যাটারিচালিত তৈরিতে ৪-৫ হাজার টাকা মজুরি নেওয়া হয়। মাসে ৩-৪টা অটোরিকশা তৈরি করা যায়।

শহরের বাইপাস এলাকার ছোট উদ্যোক্তা মুন্না মৃধা বলেন- ব্যাটারিসহ একটি অটোরিকশা খরচ প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রাথমিক অবস্থায় ক্রেতার কাছ থেকে ৭০-৮০ হাজার অগ্রিম নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। বাকি টাকা ক্রেতার হাতে দেওয়ার পর নেওয়া হয়। তবে অটোরিকশা প্রস্তুত করতে বাকি প্রায় ৭০ হাজার টাকার জন্য বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে বাড়তি সুদের ওপর ঋণ নিতে হয়। এতে আয়ের একটি অংশ ঋণ পরিশোধে চলে যায়। তবে ব্যাংক থেকে অল্প সুদে ঋণ না পাওয়া গেলে সুবিধা হয়। কিন্তু ব্যাংকে জমি বা ঘরবাড়ির কাগজপত্র দিতে হয় যা সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয় না।

নওগাঁ বিসিক শিল্পনগরী উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন- দিন দিন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে কর্মসংস্থান। তেমনি বেড়েছে কারখানার সংখ্যাও। শিল্প সম্ভাবনা বাড়াতে কারিগরি প্রশিক্ষণসহ সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই কর্মকর্তা।