জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি
প্রকাশ : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নেত্রকোনা প্রতিনিধি

মিষ্টিটি আকারে বালিশের মতো বড় না হলেও দেখতে অনেকটা বালিশের মতো এবং এর উপরে ক্ষীরের প্রলেপ থাকাতে একটি আবরণীসমেত বালিশের মতো দেখা যায়। এই মিষ্টি গয়ানাথের বালিশ নামেও পরিচিত।
বিয়ে, জন্মদিন, ঈদ, পূজা, নতুন জামাইয়ের শশুরবাড়ি আগমনসহ বিভিন্ন উৎসবে জেলার মানুষ বালিশ মিষ্টি বেশ আগ্রহের সঙ্গে কিনে নিয়ে যান। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেত্রকোনায় ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসু মানুষ বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে আসেন জেলা শহরের বারহাট্টা রোডের গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। জেলার ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টি এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিত একটি পণ্য। দেশের বাইরে যাওয়ার সময় অনেকে ভালোবেসে নিজ জেলার স্মারক হিসেবে নিয়ে যান এ মিষ্টান্ন।
বালিশ মিষ্টি তৈরি হয় দেশীয় গাভির খাঁটি দুধ-ছানা, চিনি ও ময়দা দিয়ে। প্রথমে দুধের ছানার সঙ্গে সামান্য ময়দা মিশিয়ে মণ্ড তৈরি করা হয়। এরপরে বানানো হয় বিভিন্ন সাইজের বালিশ। পরে তা ভাজা হয় চিনির গরম রসে। এরপর ঠান্ডা করেও চিনির রসে ডুবিয়ে রাখা হয় অনেকক্ষণ। এক সময় তা রসে টইটম্বুর হয়ে যায়। বিক্রির সময় বালিশের ওপর দেওয়া হয় ক্ষীরের প্রলেপ বা দুধের মালাই। এ ছাড়াও বালিশ বানানোর প্রক্রিয়ায় কিছুটা গোপনীয়তা আছে যা ব্যবসার স্বার্থে প্রকাশ করতে চান না কারিগররা। পূর্বে দাম কম তুলনামূলক কম থাকলেও বাজারে বালিশ মিষ্টির কাঁচামালের দাম বাড়ায় বেড়েছে এ মিষ্টির দামও। ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার দিক বিবেচনা করে বিভিন্ন আকৃতি ও দামে বিক্রি করা হয় এ মিষ্টি।
এ মিষ্টি ৩০, ৫০, ১০০, ৩০০, ৫০০, ১০০০ টাকা দামে বিভিন্ন আকৃতিতে পিস হিসেবে বিক্রি করা হয়। বড় আকৃতির বালিশ মিষ্টি একা খাওয়া সম্ভব হয় না, এক হাজার টাকার বালিশ মিষ্টি ৫-৬ জনে অনায়েসে খাওয়া যায়। গয়ানাথের অন্যতম স্বত্বাধিকারী বাবুল মোদকসহ কারিগড়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বালিশ মিষ্টির জনক গয়ানাথ ঘোষ। হিন্দুদের মধ্যে ঘোষ পরিবার মিষ্টি তৈরিতে বিখ্যাত।
নেত্রকোনা শহরের বারহাট্টা রোডের ‘গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর স্বত্বাধিকারী গয়ানাথ ঘোষ শত বছরেরও বেশি সময় আগে বালিশ মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। গয়নাথের স্বপ্ন ছিল নতুন ধরনের মিষ্টি আবিষ্কার করা। একদিন তিনি বিশাল সাইজের একটি মিষ্টি তৈরি করলেন এবং ক্রেতাদের খেতে দিলেন এবং ক্রেতারা খুব প্রশংসা করল। তাই ক্রেতাদের পরামর্শে মিষ্টির নাম রাখেন বালিশ। স্বাদে অতুলনীয় হওয়ায় অল্পদিনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে বালিশের নাম। এর উদ্ভাবক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান গয়ানাথ ঘোষও। তাই এক সময় তার নামটিও জড়িয়ে যায় বালিশের সঙ্গে। লোকমুখে বালিশের নাম হয়ে ওঠে ‘গয়ানাথের বালিশ’।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় ঘোষ পরিবারের অনেকেই ভারতে চলে যান। কিন্তু গয়ানাথ ঘোষ যাননি। কিন্তু পরিবারের টানে গয়ানাথ ঘোষ ১৯৬৯ সালে ভারতে চলে যান। এ সময় তিনি প্রতিষ্ঠানটি বালিশ তৈরির প্রধান কারিগর নিখিল মোদকের কাছে তা বিক্রি করেন। নিখিলের মৃত্যুর পর এটি এখন পরিচালনা করছেন, তার তিন ছেলে বাবুল, দিলীপ ও খোকন মোদক। বড় ছেলে বাবুল মোদক জানান, গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের প্রতিষ্ঠাতা গয়ানাথ ঘোষ, উনি একশ বছর আগে এ দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন। গয়ানাথ ১৯৬৫ সালে আমার বাবা নিখিল চন্দ্র মোদকের কাছে প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করে দেন। আমার বাবা উনার প্রতিষ্ঠানে মিষ্টি তৈরির প্রধান কারিগর ছিলেন, ১৯৬৫ সালে বাবা এই প্রতিষ্ঠান কেনার পর থেকে আমরা তা পরিচালনা করে আসছি।
নেত্রকোনা ছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠানের কোথাও কোনো শাখা নেই। আমরা অনলাইনে পার্সেলেও এ মিষ্টি বিক্রি করি না, যদি কেউ বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে নেত্রকোনায় এসে গয়নাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকেই নিতে হবে। এটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা নেত্রকোনাবাসী গর্বিত।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান বাসসকে জানান- নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি সারাদেশেই পরিচিত, নেত্রকোনার নাম মুখে নিলেই বালিশ মিষ্টির কথা সবার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে, আমরা নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টিকে জিআই পণ্যে ঘোষণার জন্যে সব প্রসিডিওর মেইনটেইন করে পত্র লিখেছি এবং যতটুকু শুনতে পেরেছি এটির অনুমোদন হয়ে গেছে। অফিশিয়াল চিঠি পেলেই আমরা এই জিআই পণ্যের যে সার্টিফিকেট তা গ্রহণ করার জন্যে যাব এবং এটিকে উদযাপন করব। এরআগে আমরা জেলার বিজয়পুরের সাদামাটি জিআই পণ্যের সার্টিফিকেট আমরা গ্রহণ করেছি, এখন যদি আমরা বালিশ মিষ্টির জিআই সার্টিফিকেটটি পাই তাহলে অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের আরও একটা ধাপ এগোলো। জেলায় এমন আরও কোনো পণ্য থেকে থাকলে সেগুলো অনুসন্ধান করে সেগুলো যেন জিআই পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় সে প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব।
