পুরোনো ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি, ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বাঞ্ছারামপুর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে অবৈধভাবে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির সৃষ্ট ধোঁয়ার ফলে শ্বাস কষ্টসহ নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ফলে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়েছে এলাকাবাসী। এছাড়া ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির ফলে তিন ফসলি জমিরও হুমকির মধ্যে পড়ছে। ৫/৬ মাস ধরে উপজেলার ২নং পাহাড়িয়াকান্দি ইউনিয়নের ৩ ওয়ার্ডের ডোমরাকান্দির (নবীপুর) গ্রামে নদীর ধারে জমির ওপর প্রতিদিন ট্রাক ভর্তি পুরানো ব্যাটারি এনে রাত ৯/১০ টার পর আগুনে পোড়ানো হচ্ছে।

প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই কোনো প্রকার আইনের তোয়াক্কা না করে খোলা জায়গায় পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করছেন এক ব্যক্তি। তিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে এ অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তার বেশ কয়েকজন অংশীদার রয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। বাঞ্ছারামপুর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক এমরান হোসেন কামাল বলেন, গ্রামের মানুষ, ফসলি জমি, স্বাস্থ্য সব হুমকির মুখে। আমরা প্রশাসনসহ সাংবাদিকদের জানিয়েছি। এলাকাবাসীর দাবি পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করার ফলে পরিবেশের মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। কারণ ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি এবং কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি করার ফলে কালো ধোঁয়ার কারণে আশপাশের এলাকায় লোকজনের দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের অজানা রোগ এবং ছোট বড় সকলের দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক গতকাল রবিবার এই ব্যাপারে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার ফলে উল্টো প্রতিবাদ কারীদের বিভিন্ন হামলা মামলার ভয় দেখিয়ে এলাকা ছাড়ার হুমকি প্রদান করে সীসালোভী পক্ষ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির ফলে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরির ফলে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসে ভেসে আসে ঝাঁঝালো গন্ধ। যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। শুধু তাই নয়, মানুষের জন্য ও বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতের আঁধারে শ্রমিকরা কোনোপ্রকার নিরাপত্তা বালাই না রেখে খোলা জায়গায় হাত-মুখে গ্লাভস ও মার্কস না পরে আগুন জ্বালিয়ে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করছে।

জানা গেছে, এই ভাবে রাতে একই চুল্লিতে পুরাতন ব্যাটারি পুড়িয়ে সেই ব্যাটারি থেকে সিসা বের করা হয়। পরে সেই সিসা আবার লোহার তৈরি কড়াইয়ে ঢেলে পাটা তৈরি করা হয় এবং প্রতিটি পাটার ওজন প্রায় ৩০/৩২ কেজি। পরে, এগুলো চড়া দামে বিক্রি হয়। এই ব্যাপারে পথচারী আলামিন মিয়া বলেন, পুরোনো ব্যাটারির সিসা গলানোর কারণে এলাকার অনেক মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগবালাইসহ শ্বাসকষ্টের রোগে ভুগছে। এসিডযুক্ত ধোঁয়া নির্গত হওয়ায় জমির ফসলের ক্ষতির কারণ।

ব্যাটারি কারখানার মালিক সাইফুল ইসলাম মুঠোফোনে গতকাল রবিবার এই ব্যাপারে বলেন, আমরা ব্যাটারি কারখানা থেকে নষ্ট ব্যাটাান এনে সেগুলো থেকে সিসা বের করে আগুনে গালিয়ে বাটা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করি। আমরা কারও কোনো ক্ষতি করি না। তবে যেহেতু এলাকাবাসী চায় না, আমরা শিগগিরই এটি বন্ধ করে দেবো। সীসা তৈরির অংশীদার ওবায়দুল্লাহ মুঠোফোনে বলেন, আমাদের ট্রেডলাইসেন্স আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নেই।

বাঞ্ছারামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন এই ব্যাপারে বলেন, সিসা এমনই এক খারাপ পদার্থ। এইটা যেখানে পড়বে, সেখানে কোনো ধরনের ফসল হবে না। হলেও সেটা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বাঞ্ছারামপুর উপজেলা সরকারি হাসপাতালে টিএসআই ডা. রঞ্জন বর্মন বলেন, ব্যাটারির আগুনে পুড়লে ব্যাটারিতে থাকা সীসা, এ্যাসিড, পারদ, নিকেল ও ক্যাডমিয়াম পুড়ে বিষাক্ত কালো ধোয়া আর অদৃশ্য গ্যাস বাতাসে মিশে পরিবেশকে দূষিত করছে। আর দূষিত বাতাস নিশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের ফুসফুসে ঢুকে ক্যান্সার, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণসহ শিশুদের বিকলাঙ্গ মতো মারাত্মক অসুখের সৃষ্টি হয়।

পরিবেশ নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘তরী বাংলাদেশ’ এর প্রধান সমন্বয়ক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) শামীম আহমেদ বলেন, নদীর পানিতে মিশে পানি দূষিত হয়ে জলজপ্রাণীর মারাত্মক হুমকির সম্মুখে পড়তে পারে। তাছাড়া, পোড়ানোর পর যে অ্যাসিড আর রাসায়নিক গলে বের হয়, সেগুলো নদীতে মিশে পানি একেবারে বিষাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে মাছ মরে যায়, গরু-ছাগল সেই পানি খেয়ে অসুস্থ হয়। গ্রামের মানুষ যদি সেই পানি খায় বা ব্যবহার করে, ধীরে ধীরে কিডনি বিকল, লিভার নষ্ট, রক্তে বিষ জমে যাওয়া, শিশু জন্মগত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।’

বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফেরদৌস আরার ভাষ্য, অবৈধ সিসা কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে আইন অনুযাযী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, মানবদেহের জন্য হুমকিস্বরুপ ও জমির ফসলের জন্য ক্ষতিকর সেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমরা মোবাইল কোর্ট চালাবো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক রাকিবুল হাসান বলেন, বিষয়টি আমরা জানতাম না। আজই ডিসি স্যারকে বিষয়টি অবহিত করে ব্যবস্থা নিবো। কারণ, ওরা আমাদের কাছ কোনো অনুমতি নেয়নি।