বাউলধামে মাতোয়ারা আখড়াবাড়ি
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচএম আরিফ, কুষ্টিয়া

ফকির ইদ্রিস সাঁই। প্রবীণ লালন ভক্ত। এসেছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর গ্রাম থেকে। একাগ্রচিত্তে গেয়ে চলেছেন, ‘আর কি হবে এমন জনম বসবো সাধুর মেলে। হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায় ঘিরে নিল কালে।’ ফকির ইদ্রিস সাঁইর মত অসংখ্য বাউল, সাধু, গুরু, বৈষ্ণবের আগমনে এখন মুখরিত কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ি, লালনধাম। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন গতকাল শনিবারও একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, আর প্রেমজুড়ির তালে মাতোয়ার হয়ে উঠেছেন বাউলরা। বাউল সম্্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের মৃত্যুর ১৩৫ বছর ধরে এভাবেই বাউল সাধকরা জড়ো হন বাউলতীর্থে। এবার ১৭ অক্টোবর জাতীয়ভাবে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে সাঁইজির তিরোধান দিবস হওয়ায় এর কদিন আগে থেকে ভক্তরা আসতে শুরু করেন আখড়া বাড়িতে।
কোনো দাওয়াত নেই, পত্র নেই, তবুও এক উদাসি টানে মানুষ ছুটে এসেছেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। যেখানে মিলন ঘটেছে নানা ধর্ম, নানা বর্ণের মানুষের। কেউ এসেছেন ধবধবে সাদা পোশাকে, আবার কেউ গেরুয়া বসনে। সাঁইজির টানে এ ধামে বাউল ছাড়াও সাধারণ দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেছে। ‘বাড়ির পাশে আরশি নগর, মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই কুল হারাবি, মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি, সত্য বল সুপথে চল, এলাহি আলামিন গো আলা বাদশা আলমপনা তুমি’ এ রকম অসংখ্য লালন সংগীতের সুরের মূর্ছনায় তারা মাতিয়ে তুলেছেন বাউলধাম। লালন মাজারের আশপাশে ও মরা কালী নদীর তীর ধরে বাউলেরা ছোট ছোট আস্তানা গেড়ে সাঁইজিকে স্মরণ করেছেন গানে গানে।
বাউল-ফকিরদের সঙ্গে সুর মেলাতে ভুল করছেন না ভক্তরাও। লালন সাঁইজি জীবিত থাকাকালে ফাল্গুন মাসের শেষে দোল পূর্ণিমা তিথিতে কালী নদীর তীরে শিষ্যদের নিয়ে রাতভর গান-বাজনা ও তত্ত্ব আলোচনা করতেন, তার এই কর্মযজ্ঞ যা কালক্রমে পরিণত হয়েছে লালন স্মরণোৎসবে। দূরদূরান্ত থেকে সাদা বসনে বাউল সাধকরা এসেছেন দলে দলে একতারা-দোতারা, ঢোল-খোল, বাঁশি, প্রেমজুড়ি, চাকতি, খমক হাতে। ক্ষণে ক্ষণেই খণ্ড খণ্ড মজমা থেকে নৃত্যসঙ্গীতের তালে তালে ছলকে উঠছে যেন উত্তাল ভাববাদী ঢেউ। কেউ শুধু লুঙ্গি পরে নাচছেন, গাইছেন। কারও উদোম গা। গলায় বিচিত্র বর্ণ ও আকারের পাথরের মালা। হাতে বিশেষ ধরনের লাঠি ও বাদ্যযন্ত্র। লালন ধামের ভেতর ও বাইরে নিজেদের পছন্দমতো জায়গা করে নিয়ে গান-বাজনা করছেন তারা। বিচিত্র সব বাদ্যযন্ত্রে তুলছেন হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লালনগীতি। আখড়ার একটি দল থামছে তো অন্যটি জমিয়ে রাখছে চারপাশ।
বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরু কর্তৃপক্ষের দেওয়া সকালের অধিবাসে পায়েশ ও মুড়ির বাল্যসেবা নেন। গত শুক্রবার দুপুরে তারা মরা কালীগঙ্গায় গোসল সেরে ইলিশ মাছ-ভাত ও ত্রিব্যঞ্জন দিয়ে (তিন ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) দুপুরের খাবার পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। পুণ্যসেবা গ্রহণ কেন্দ্র করে দুপুর ১টায়, লালন একাডেমির প্রধান ফটক তখন বন্ধ। ভেতরে লাইন দিয়ে কলাপাতা সামনে নিয়ে হাজার হাজার সাধু ফকিরের অপেক্ষা। সবাই খাবার পাবার পর বিশেষ আওয়াজ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো বিতরণ শেষ। এবার খাওয়া শুরু হলো একযোগে। ইলিশ মাছ, ভাত ও সবজি দিয়ে প্রায় ৫ হাজার বাউল, সাধু ফকির পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। এছাড়াও দই মিষ্টি খাওয়ানো হয়। দাওয়াত ছাড়াই মানুষ ছুটে আসে দলে দলে, হাজারে হাজারে। কোন সে উদাসী ডাকে তা কেউ জানে না।
লালন ধামের ভেতর পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী বাউল কামিরন তার সহযোগীদের নিয়ে একতারা হাতে নেচে-গেয়ে সাঁইজির বন্দনা করছিলেন। কথার পিঠে কথা আর মনের ভেতর আধাত্ম্যবাদ নিয়ে গাইছিলেন তিনি। কামিরন বলেন, লালন নিজেও এভাবে গান করতেন। তার কাছে ধর্ম, বর্ণ, জাত-পাতের বিচার ছিল না। পুরুষের পাশাপাশি আশ্রয়হীন নারীদের তিনি বাঁচার সুযোগ করে দিতেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে গাইতেন, নাচতেন।
কোনো এক অচিন গাঁয়ের অচেনা মানুষ ফকির লালন এখানে বসেই জীবনভর সন্ধান করেছেন, অচিন পাখির সহজ কথায় বেঁধেছেন জীবনের গভীরতম গান। আধ্যাত্মিক দর্শন লাভের আশায় দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত-অনুসারীরা এখন এখানে আরও বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়সহ কোনো সমস্যা হয় কি-না দেখার জন্য লালন একাডেমির সদস্যরা সদা সতর্ক। তবে লালন একাডেমির পক্ষ থেকে বাউলদের অধিবাস সেবা, বাল্যসেবা বা বালক সেবা ও পূর্ণসেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাউলরা একসঙ্গে বসে গ্রহণ করেন সেবা। সমাধিতে গাঁদা ফুল, আতর, গোলাপ ছড়িয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন হাজারো শিষ্য-ভক্ত। এদিকে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৫ তিরোধান দিবসের ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার ২য় দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার।
উৎসবে শামিল হতে সুদুর ফ্রান্স থেকে ছুটে এসেছেন দেবরা জান্নাত, খুলনা থেকে এসেছেন নববিবাহিত দম্পতি। সৌদি প্রবাসী স্বামী আব্দুল গাফফার বলেন, ‘লালনের গানে মানবতা বোধ, অহিংস ভাব ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণে দিন দিন তার গানের ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্ত্রী নারগিস পারভিন বলেন, লালন সাঁইজির এ আদর্শ অনুসরণ করলে দেশে বর্তমান হানাহানি বন্ধ হয়ে যেত। তিনি লালনের গান কবিতা আকারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করারও দাবি জানান।
