বিলুপ্তির পথে সুস্বাদু বৈরালি মাছ
প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিফুর রশীদ, লালমনিরহাট

লালমনিরহাটের তিস্তা ও ধরলা নদীর ঐতিহ্যবাহী বৈরালি মাছ বিলুপ্তির পথে। ব্যাপক চাহিদা থাকলেও সুস্বাদু এই মাছটি জেলেদের জালে আর আগের মতো ধরা পড়ে না। যেটুকু পাওয়া যায় বাজারে তা বিক্রি হয় অত্যধিক চড়া মূল্যে। দেশের উত্তরাঞ্চলে জেলা লালমনিরহাটে অসম্ভব জনপ্রিয় এই মাছের সংকট স্থানীয়দের মধ্যে গভীর হতাশার জন্ম দিয়েছে। সচেতন এলাকাবাসীর অভিযোগ, উজানে ভারতের একাধিক জায়গায় ও বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধায় সেচের জন্য বাঁধ দেওয়ার ফলে তিস্তা নদীতে স্রোত কমে চর পড়ে যাওয়ায় এবং ধরলা নদীর বাংলাদেশ অংশে পানি কম প্রবাহিত হওয়ায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে বৈরালি মাছ। একই কারণে নদীর দেশি প্রজাতি মাছের সংখ্যাও কমে গেছে মারাত্মকভাবে। হারিয়ে গেছে শুশুক, ঘড়িয়াল, মিঠা পানির কচ্ছপসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী।
স্থানীয়ভাবে বৈরালি বা বৈরালী নামে পরিচিত এই মাছটিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ডাকা হয় বোরালি নামে।
বই-পত্রেও এটি বোরালি নামে চিহ্নিত। বোরালি মাছের বৈজ্ঞানিক নামণ্ডবারিলিয়াস বারিলা (বারিলিয়াস বারিলা)। এটি মূলত স্বচ্ছ পানির মাছ। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা নদী তিস্তা-ধরলায় এই মাছ পাওয়া যায়। তিস্তা-ধরলার ধারা নামায় ব্রহ্মপুত্র নদীতেও এই মাছ কিছু পরিমাণে মেলে। বাংলাদেশে কেবল উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামেই এই মাছ পাওয়া গেলেও বৈরালি বা বোরালি মাছের বিস্তার ভারত, নেপাল, মিয়ানমারের পাহাড়ি নদীগুলো জুড়েই। বোরালি মাছ সর্বোচ্চ ৬-৭ ইঞ্চি বা ১০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং প্রস্থে প্রায় ১ ইঞ্চি আকারের হয়ে থাকে। রূপালী রঙের মাছটির গায়ে ছোট ছোট আঁশ, পিঠের রং হালকা মেটে। পেটের নিচে হলুদ দাগ থাকে। মাছটির পুঁটি মাছের মতো কাঁটা থাকলেও তা খুবই নরম। বৈরালি মাছ গ্রীষ্মকালীন সময়ে বংশ বিস্তার করে থাকে। দ্রুতগতির এই মাছটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনেকটা ইলিশ মাছের মতোই। তীব্র স্রোতে উজানের দিকে ছুটে চলে বৈরালির ঝাঁক। দিনের বেলা গভীর পানিতে সরে গেলেও সাধারণত বিকাল থেকে রাতের দিকে মাছটি নদীর কিনারের দিকে পানির ওপরের স্তরে ঝাঁক বেঁধে চলে আসে।
জেলেরা ছোট ছোট ‘চটকা জাল’ (হাতে টানা জাল) দিয়ে বৈরালি শিকারও করেন বিকাল থেকে রাতের মধ্যেই। জেলেরা জানিয়েছেন, ইলিশ মাছের মতোই বৈরালি মাছ জালে ধরার পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যায়।
আবার দ্রুত বরফ দিতে না পারলে বেশিক্ষণ সংরক্ষণও করা যায় না। জানা গেছে, তিস্তা ও ধরলা নদীর উজানে ভারত বাঁধ নির্মাণ করে সেচ কাজের জন্য এক তরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ভাটিতে তথা বাংলাদেশ অংশে তিস্তা ও ধরলায় প্রকট আকারে পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই দুই নদী থেকে বৈরালি মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণির বিলুপ্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে বর্তমানে সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে মাছটির বংশ বিস্তার এবং পুকুরে চাষযোগ্য কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।
লালমনিরহাট জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে- লালমনিরহাট জেলায় তিস্তা, ধরলা, রত্নাই, সানিয়াজানসহ মোট ১৩টি নদী রয়েছে। এসব নদী মোট ১,৯৬১ হেক্টর জমির মধ্যে রয়েছে। তাছাড়াও জলাশয়ের মধ্যে বিল ১,১৯৬ হেক্টর, পুকুর ২,৫৩৩ দশমিক ৪২ হেক্টর, ধানখেত ১,৬৩৪ হেক্টর, বরোপিট ১১৩.৮০ হেক্টর, পেন কালচার ১৫০.৫০ হেক্টর, প্লাবন ভূমি ২,২১০.৪০ হেক্টর ও খাল ২৮৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ ও উৎপাদন হয়ে থাকে। এসব উৎস থেকে সারা বছর ১৮,৪৬০ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে লালমনিরহাট জেলাবাসীর সারা বছরের মোট চাহিদা থেকে এই উৎপাদন ১০,১২৪.৯৩ মেট্রিক টন কম।
