অবৈধ চায়না জালে অচল বাঁশের চাঁই-পলো

বিলীন হচ্ছে দেশি মাছ * ঐতিহ্য হারানোর ঝুঁকি * পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি

প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সরিষাবাড়ী (জামালপুর) প্রতিনিধি

বৃষ্টি হলে বা নদীতে পানি এলেই খাল-বিল, নদী-নালায় শুরু হয় মাছ ধরার উৎসব। আধুনিকতার ছোঁয়া ও অবৈধ কারেন্ট জালের দৌরাত্ম বাড়ার কারণে তেমন চলছে না গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেতের তৈরি ডারকি, চাঁই, পলো ও আনতার মতো দেশীয় মাছ ধরার ফাঁদ। মানবেতর জীবনযাপন করছে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষরা। গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি করা হয় বাঁশ ও বেতের তৈরি এসব পণ্য। গ্রামগুলোতে বর্ষা ও বন্যার পানির সঙ্গে আজও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে এই মাছ ধরার সরঞ্জামগুলো। তবে অবৈধ চায়না জাল ব্যবহার বন্ধের জন্য সরকারের সহযোগিতা চান বাঁশ ও বেত শিল্পের কারিগররা।

উপজেলার পৌর এলাকার কোনাবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়িতেই প্রতিবছরই বর্ষাকালে ও বন্যার শুরুতে এ পল্লীতে শুরু হয় বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি মাছ ধরার ফাঁদ- চাঁই, পলো ও আনতা তৈরির কাজ। আগে এই সময়টুকুতে খাওয়ার সময় পেতেন না বাঁশ-বেতের কারিগররা। স্থানীয় হাটবাজারে প্রতি হাটের দিনগুলোতে নানা ডিজাইন, নানা রঙের ও বিভিন্ন আকারের চাঁই, পলো ও আনতা বিক্রি করা হতো। তবে একসময় গ্রামে গ্রামে এসব ফাঁদের ব্যবহার বেশি থাকলেও এখন বাঁশ ও বেতের দাম বৃদ্ধির কারণে ও অবৈধ বিভিন্ন চায়না জাল বাজারে নামার কারণে একবারেই বিক্রি নেই বললেই চলে এসব চাঁই, পলো ও আনতার। আবার গভীর রাতে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাটারি দিয়ে নদীর পানিতে কারেন্টের শক দিয়েও অবৈধ উপায়ে ধরা হচ্ছে মাছ। এসব জেনে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে উপজেলা মৎস্য অফিস।

চাই ও পলো কারিগর বৃদ্ধ আফসার আলী, মোবারক হোসেন রোকসানা বেগম বলেন, এসব চাই পলো, ডারকি সাধারণত খাল-বিল কিংবা ডুবে যাওয়া খেতে ফেলা হয়। এটাতে শোল, শিং, কৈ, খইলসা, পুঁটি চিংড়িসহ দেশীয় সব মাছ সহজেই ধরা পড়ে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বড় আকারের চাঁই তৈরি হচ্ছে, এগুলোতে রুই-কাতলও ধরা সম্ভব। দেশীয় এসব ফাঁদ শুধু মাছ শিকারিদের জীবিকা নয়, বরং আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ। তবে বিভিন্ন অবৈধ কারেন্ট জাল বাজারে আসায় ও এসব ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এই শিল্পটি ঐতিহ্য হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে। এসব অবৈধ কারেন্ট জাল ও চায়না জাল নিষিদ্ধ ও বিক্রি বন্ধ করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা উদ্যোগ না নিলে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

স্থানীয় গ্রামীণ সরঞ্জাম তৈরির কারিগর ছানোয়ার হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এটা আমাদের বাপ-দাদাদের ব্যবসা ছিল। তাদের মৃত্যুর পর আমি প্রায় ৪৫ বছর ধরে আমি বাঁশ ও বেত দিয়ে মাছ ধরার চাঁই, পলো ও আনতা তৈরি করছি। আগে প্রতি মৌসুমে ৫ হাজার থেকে ৭-৮ হাজার ডারকি, পলো, আনতা ও চাই বিক্রি হতো। ২০-২৫ জন শ্রমিক কাজ কারতো। এখন প্রতি মৌসুমে ২০০ থেকে ৩০০ বিক্রি হয় না। বাজারে অবৈধ কারেন্ট জাল ও মাছ ধরার শর্কসহ নানা ধরনের আধুনিক পদ্ধতি আসার কারণে এগুলো আর চলে না। সরকার যদি এসব অবৈধ কারেন্ট জাল, চায়না জাল ও শর্কপদ্ধতির বিষয়ে অভিযান চালায় তাহলে হয়তো আমরা ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব। এ বিষয়ে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবযানী ভৌমিক বলেন, চায়না জালগুলো খুব মারাত্মক একটি জাল। এটাতে ছোট বড় মাছ ও রেনু পর্যন্ত ধরা পড়ে। আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি এই চায়না জাল বন্ধ করতে। এরইমধ্যে আমরা একাধিক স্থানে ও জালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান ও মোবাইল কোর্ডও পরিচালনা করেছি। অনেক জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অভিযানের সময় স্থানীয় মানুষদের সচেতন করারও চেষ্টা করছি।