চলনবিলে মাছ সংকটে শুঁটকি উৎপাদনে ধস
প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি

মাছের রাজ্য চলনবিলে এবার মাছের আকাল। পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাচ্ছে না বিলে। এ কারণে চরম মাছ সংকটে পড়েছে চলনবিলের শুঁটকি চাতালগুলো। প্রয়োজনীয় মাছের অভাবে একে এক বন্ধ হয়ে গেছে শুঁটকি চাতাল। শুঁটকি উৎপাদনে ধস নেমেছে।
অর্জিত হয়নি শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। সরেজমিনে চলনবিল এলাকার শুঁটকি চাতাল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়- আশ্বিন-কার্তিক মাসে বিলের পানি নামার সময় প্রচুর টেংরা, পুঁটি, খলসে, বাতাসি, চেলা, মলা, টাকি, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কৈসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। দামও কম থাকে। তখন এসব মাছ দিয়ে আমরা শুঁটকি তৈরি করতে ব্যস্ত সময় পার করেন চাতাল মালিকরা। অথচ এ বছর বিলে মাছ নেই বললেই চলে।
অগ্রহায়ণ মাসে চলে পুরো শুঁটকির মৌসুম। কিন্তু শুঁটকি তৈরির কোনো রকম মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বন্ধ হয়ে গেছে অনেক চাতাল। শুঁটকি চাতাল মালিক আ. সামাদ বলেন, গত বছর প্রায় ৮০ টন শুঁটকি তৈরি হয়েছিল তার চাতালে। এ বছর ১০-১৫ টনও বোধ হয় হবে না। মাছ কম তাই দাম বেশি। শ্রমিক মজুরিও বেশি। তাই এবার নিশ্চিত লোকসান গুণতে হবে বলে তিনি তার হতাশার কথা জানালেন। বিল এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী আব্দুল গফুর, হবি শেখ, দেলবর হোসেন, আলমাস হোসেন, মোফাজ্জল হোসেন ও কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের তথ্য মিলেছে। তাদের দেওয়া তথ্য মতে চলনবিল এলাকায় অন্তত দেড়শ চাতাল এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্যগুলোও ক্রমশ বন্ধ হওয়ার পথে। বেকার হওয়ার আশঙ্কায় ভুগছেন চলনবিলের শুঁটকি চাতালের অন্তত ৫ হাজার নারী পুরুষ শ্রমিক। প্রতি চাতালে ১০-২০ জন শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে সংখ্যায় নারী শ্রমিক বেশি।
আবহাওয়া ভালো থাকলে প্রতি মৌসুমে চাতাল চলে আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে মাঘ-ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। তিন মণ তাজা মাছ শুকালে এক মণ শুটকি পাওয়া যায়। শুঁটকি তৈরির চাতালগুলোয় কর্মসংস্থান হওয়ায় বিল এলাকার হত দরিদ্র নারী পুরুষ শ্রমিকদের দুবেলা আহারের সংস্থান হয়। এবার মাছের অভাবে শুরুতেই বন্ধ হতে বসেছে শতাধিক চাতাল। পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চলনবিল অঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার শুঁটকি মাছ তৈরি ও তা বাজারজাত করার কাজে যুক্ত ছিল। এবার তারা বেকার হয়ে পড়ার আশঙ্কায় ভুগছেন। দেশি মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিল এলাকায় ২ শতাধিক অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল পড়ে। চাতালিদের সূত্রে জানা গেছে, চলতি শুটকি মৌসুমে প্রায় ২৫ কোটি টাকা মূল্যের ১০০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের সম্ভাবনা ছিল। তবে মাছ সংকটের কারণে হয়তো উৎপাদন হবে না। দ্রুতই বন্ধ হবে চাতালগুলো। এই শুঁটকির উৎপাদনে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য।
অথচ তারা তাদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চলনবিলের দুই সহস্রাধিক পরিবার মৌসুমি এই শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত। কিন্তু এবার হয়তো বেশি দিন চাতাল চলবে না মাছ সংকটের কারণে। চলনবিলের সুস্বাদু শুঁটকির চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু প্রতি বছরই মাছের সংকটে এর উৎপাদন ক্রমশ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। চাটমোহরের চাতাল মালিক আলমাস উদ্দিন জানান, চলনবিল এলাকায় ‘সাবাড় বাহিনী’ কারেন্ট জাল ও বাদাই জাল দিয়ে পানি থেকে ছেঁকে তোলে মাছসহ অসংখ্য ক্ষুদে জলজপ্রাণি। যার কারণে মাছ সমুলে ধ্বংস হচ্ছে। প্রজননকালে মাছেরা যে সব ক্ষুদে জলজপ্রাণি মাছের খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে সেগুলো ধ্বংস হওয়ায় প্রজনন সংকটও তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে চলনবিলে এবার মাছের পরিমাণ অনেক কম। এজন্য যে সামান্য মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার দাম দিগুণ তিন গুণ বেশি। এতে শুঁটকি উৎপাদনে খরচও বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। ফলে লোকসান গুণতে হচ্ছে চাতাল মালিকদের। লাভ না হওয়ায় মালিকরা শুঁটকি চাতাল বন্ধ করে দিচ্ছেন।
চাটমোহরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল মতিন বলেন, চলনবিলে মাছ কম হওয়ার কারণ হচ্ছে- ক্ষণস্থায়ী বন্যা, চায়না দুয়ারি, কারেন্ট ও বাদাই জাল দিয়ে ও সেচে বেপরোয়া মাছ শিকার, বিলের কৃষি জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ও ঘাস মারার বিষ প্রয়োগ। এসব কারণে বিলে মাছের পরিমাণ প্রতি বছরই ক্রমশ কমেছে। তিনি জানান, চলনবিলের শুঁটকির কদর সর্বত্র। তবে এবার শুঁটকি উৎপাদন অনেক কম হবে। এ অঞ্চলে শুঁটকি মাছ সংরক্ষণে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবস্থা নিলে শুঁটকির প্রসার হবে। কয়েক বছর মাছ সংকটে শুঁটকির উৎপাদন কমে গেছে।
