অতিথি পাখির কলরবে মুখরিত চলনবিল
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি

ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিও রূপ বদলায়। আর সেই সূত্র ধরেই চলনবিল কখনও থৈ থৈ পানিতে টইটুম্বর, মাছের ভাণ্ডার, কখনও মাঠজুড়ে ফসলে ভরা সবুজের সমারোহ, কখনও মাঠজুড়ে হলুদের সমারোহ আবার কখনও পাখির কলরবে মুখর থাকে। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত চলনবিল এখন নানা অতিথি পাখির কলরবে মুখরিত। প্রতি বছরের মতো এবারও খাবারের সন্ধানে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে নানা রুপ বৈচিত্র্যের পাখি। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মিঠা পানির মাছের সন্ধানে এসব অতিথি পাখির সমাগম হয়েছে বিলটিতে। শীত মৌসুমে অতিথি এবারও পাখির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল। বিলে পাখিদের কোলাহল, কলরব, ডানামেলে অবাধ বিচরণ সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অতিথি পাখিদের আগমনে পুরো চলনবিল এলাকাই এখন দৃষ্টিনন্দন এলাকা।
‘চলনবিলের ইতিকথা’ এবং ‘জেলা পাবনার ইতিহাস’ গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিল চলনবিল। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের তিন জেলার ১০টি উপজেলার, ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ৯৩টি ছোট বিল। ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিলে চলনবিলের জলমগ্ন অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গ মাইলের বেশি। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপের এক প্রতিবেদনে চলনবিলের আয়তন দেখানো হয় ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকে। যদিও অনেকগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই। সাধারণত অক্টোবর-নভেম্বরে চলনবিল থেকে পানি নামতে শুরু করে। এ সময় খাবার সংগ্রহের জন্য চলনবিলে ঝাঁকে ঝাঁকে বক, কানা বক, ইটালি, শর্লি, পিয়াজ খেকো, ত্রিশুল, বাটুইলা, নারুলিয়া, লালস্বর, কাঁদোখোচা, ফেফি, ডাহুক, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, শামকৈলসহ বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির ঝাঁকে ঝাঁকে আগমন করছে।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই সব পাখি চলনবিলের বিভিন্ন মাঠে ও গাছে অবস্থান করে। তবে কিছু দেশি প্রজাতির পাখি সবসময় থাকে এই বিলে। সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও অতিথি পাখি আসে এই চলনবিলে। স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে পাখিপ্রেমীরাও হরেক রকম পাখি দেখতে আসছেন এ বিলে। চলনবিলে সাধারণত হারগিলা, ভাঁড়ই, ছোট সারস, শালিক, চড়ুই, বড় সারস, কাঁদোখোঁচা, নলকাক, ডাহুক, হুটটিটি, চখাচখি, বুনোহাঁস, রাতচোরা, বালিহাঁস, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তবে এ বছর বালিহাঁস, বক ও রাতচোরা প্রজাতির পাখি বেশি দেখা মিলছে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু পাখি শিকারি এ সুযোগে জাল, বিষটোপ, কারেন্ট জাল, বিভিন্ন ধরনের ফাঁদে প্রাণ দিচ্ছে বিভিন্ন জাতের পরিযায়ী পাখি ও খাঁচার মাধ্যমে অতিথি পাখি শিকার করছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
প্রত্যন্ত বিলাঞ্চলের বারুহাঁস, বস্তুল, দিঘরীয়া, গুল্টা, রানীরহাট, বিনসাড়া, ভাদাস, নাদোসৈয়দপুর, গুরুদাসপুর, কাছিকাটাসহ বেশ কয়েকটি বাজারে সকালে এসব পাখি বিক্রি করা হয়। প্রতিটি বক ১০০-১৫০ টাকা, রাতচোরা ৩০০-৪৫০ টাকা জোড়া, বালিহাঁস ৪০০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। স্থানীয়দের কাছে পাখির মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। লোকজন আগে থেকেই পাখি শিকারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। বিশেষ করে মোবাইল ফোনে। অনেকে অগ্রীম টাকা দিয়ে রাখেন। পরে তাদের বাড়িতে গোপনে পাখি পৌঁছে দেন শিকারিরা।
১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দণ্ডের বিধান থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ নেই। চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল এলাকার বাসিন্দা হাসু বলেন, ‘বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ বিলে ঝাঁকে ঝাঁকে নানা রঙয়ের দেশি-বিদেশি পাখি খাদ্য সংগ্রহের জন্য ভেসে বেড়ায়। চলনবিল থেকে পানি নামার সময় ফাঁকা মাঠে ও জলাশয়ে পুঁটি, দারকিনা, মলা, খলসেসহ প্রচুর পরিমাণে ছোট মাছ ও পোকাণ্ডমাকড় পাওয়া যায়। খাবারের লোভে ও অপেক্ষাকৃত শীত থেকে বাঁচতে নানা প্রজাতির পাখি চলনবিলে আশ্রয় নেয়। এছাড়া বোরো মৌসুমেও পাখির দেখা মেলে চলনবিলে। তখন পোকামাকড় খেতে আসে। কিন্তু বিলের মধ্যে একদিকে জাল টানিয়ে পাখি শিকারিরা লাঠি হাতে অন্যদিক থেকে সেগুলোকে তাড়া করে। তাড়া খেয়ে ভয়ে পাখিরা জালে ও ফাঁদে পড়লে খাঁচায় আটকে যায়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন- পাখিরা শুধু প্রকৃতির শোভা বাড়ায় না, পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে। পোকাণ্ডমাকড় খেয়ে এরা কৃষকের উপকার করে। কিন্তু আইন থাকলেও পাখি নিধন বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। এ কারণে এ অঞ্চল থেকে নানা প্রজাতির দেশি পাখি বিলুপ্ত হচ্ছে এবং পরিযায়ী পাখি আসার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, ‘পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ। আমরা পাখি শিকারিদের অপতৎপরতারোধে বিলে অভিযান পরিচালনা করব।’
