নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যক্রম দীর্ঘদিন যাবৎ চলে আসছে। এ ব্যাপারে এক সময় এনজিওগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সরব থাকলেও সরকার পিছিয়ে ছিল, তা বলা যাবে না। বরং নারী ক্ষমতায়নে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের সুফল এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) লক্ষ্য ও অভীষ্ট অনুযায়ী সব ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে বদ্ধপরিকর বর্তমান সরকার। একইভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা আনতেও অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্যে গত এক দশক ধরেই কাজ করছে সরকার। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ সময়ে নারী ক্ষময়তায়নের প্রাপ্তি কতটুকু। এর চিত্র পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিসিএস) রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২০-এর ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ (এমএসভিএসবি)’ প্রকল্প তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদনে। বলা হয়, এ সময়ে জাতীয় সংসদ আর স্থানীয় সরকারে জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া অন্য কোথাও নারীর অবস্থান সুসংহত হয়নি। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণের মাত্রাও কমেনি। প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারীরা এখনও পুরুষ দ্বারা উচ্চমাত্রায় নিয়ন্ত্রিত। দেশের ৮৫ ভাগ পরিবার এখনও পুরুষ দ্বারা শাসিত। পুরুষরাই এসব পরিবারের প্রধান। তবে এক বছর আগে ২০১৯ সালে পরিবারপ্রধান হিসেবে পুরুষের অংশগ্রহণ ছিল আরও বেশি ৮৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এক বছরে এটা দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে।
তবে গত এক দশকে দুটি জায়গায় নারীরা বেশ এগিয়েছে বলে প্রতিবেদনের বরাতে প্রকাশ। এর একটি নারীদের আয়ুষ্কাল বেড়েছে। বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের তুলনায় অন্তত আড়াই থেকে তিন বছর বেশি বাঁচেন। অন্যটি তালাকের ক্ষেত্রেও পুরুষের তুলনায় এগিয়ে নারীরা। তালাকের ক্ষেত্রে নারীর শতকরা হার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ আর পুরুষের ক্ষেত্রে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও অবশ্য নারীর অবস্থান আগের চেয়ে বেশ মজবুত। অন্যদিকে শিক্ষার হারের ক্ষেত্রেও নারী পিছিয়ে। শহর কিংবা গ্রাম উভয় ক্ষেত্রেই নারীর শিক্ষার হার পুরুষের তুলনায় কম। এ ক্ষেত্রে পুরুষের হার ৭৭ দশমিক ৪ আর নারীর ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ। অবশ্য ২০১৬ সালের তুলনায় এ সূচকে নারী-পুরুষ উভয় পক্ষই বেশ উন্নতি করেছে। কিন্তু সংসদ ও স্থানীয় সরকার ছাড়া অন্য কোথাও নারীর প্রতিনিধিত্ব খুব একটা এগোয়নি। প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, স্পিকার তিনজনই নারী। এ ছাড়া প্রশাসন, শিক্ষা, স্থানীয় ও সংসদ নির্বাচনে নারীর অংশগ্রহণ কিছুটা বেড়েছে। দেশে সরকারি-বেসরকারি ১৫৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী ভিসি আছেন মাত্র দু’জন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সচিব পদমর্যাদায় কর্মরত আছেন ৮৮ জন। এর ১১ জন নারী। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সাতজন বিচারপতির মধ্যে একজন নারী। তবে ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে শিক্ষা খাতে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই নারী শিক্ষক।
পরিসংখ্যানের দিতে তাকালে বলা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে আছেন। তবে সাফল্যের চিত্রও নেহাত কম নয়। নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের অগ্রযাত্রায় নারীরা দ্রুত উঠে আসছে। আনুপাতিক হারে কম হলেও পুরুষের পাশাপাশি বাংলাদেশি নারী সর্বত্রই কাজ করছেন। এমনকি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অন্যতম পর্বতারোহী হিসেবেও নারী হিমালয় জয় করেছে। আবার বিমান ও ট্রেনচালনায়ও পারদর্শী হিসেবে নাম লিখেয়েছেন। নির্মাণ খাতে তো অনেক আগে থেকেই নারী কাজ করছেন। দেশের বৃহৎ শিল্প খাত হিসেবে পরিচিত তৈরি পোশাক শিল্পে নিয়োজিত প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিকের অন্তত ৮০ ভাগই নারী। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের সমাজও এখন নারী অগ্রগতির জন্য বাধা নয়। তবে আমাদের সমাজকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে নারীর ক্ষমতায়ন।