সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর সরকার যখন সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা (ছঁধষরঃু ঊফঁপধঃরড়হ) অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তখনই বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ আমাদেরকে ঘরে বসে থাকতে বাধ্য করেছে। করোনাভাইরাস নিজের রূপ পরিবর্তন করে সর্বশেষ অমিক্রনের মাধ্যমে আমাদের আবার বিপদের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সরকার বাধ্য হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। দক্ষ, প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও আদর্শ নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখন আধুনিকরূপে গড়ে তোলা হচ্ছে। শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য শিক্ষকদের জন্য আইসিটি ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে তারা বিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করতে সক্ষম হচ্ছেন। শিক্ষার্থীরাও তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করছে। শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তারা কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন যায়গার নতুন নতুন জ্ঞানার্জন করছে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (ঝঁংঃধরহধনষব উবাবষড়ঢ়সবহঃ এড়ধষং) এর অন্যতম হচ্ছে, ‘সবার জন্য নায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণ’। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বর্তমানে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। প্রত্যেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সুসজ্জিতভাবে সাজানো হয়েছে। স্কুল-মাদ্রাসায় ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও বর্তমানে সমৃদ্ধ ল্যাব আছে। এসব কাজের উদ্দেশ্য ডিজিটাল পদ্ধতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে শিক্ষা অর্জন করা এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়া। তবে এখনও অনেক স্কুল-কলেজে কম্পিউটার ল্যাব নেই। সেখানে অবকাঠামোগত ত্রুটির কারণে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো পাঠ গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে মানসম্মত শিক্ষা কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে।
শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে এবং শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধের জন্য মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষক পাঠদান করছেন। শিক্ষকদের মানোন্নয়ন ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
আবার অনেক প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। এসব প্রশিক্ষণের মধ্যে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকরা ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি বা সংগ্রহের মাধ্যমে সহজবোধ্য ও আকষর্ণীয় পাঠদানে সক্ষম হচ্ছেন। দুর্যোগকালে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ‘ঘরে বসে শিখি’ শিরোনামে টেলিভিশনে ক্লাস পরিচালনা করছে। এছাড়া মাধ্যমিকে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ এবং ‘আমার ঘরে আমার মাদ্রাসা’ নামে অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা স্কুল-মাদ্রাসায় উপস্থিত না হয়েও তাদের পাঠ সম্পন্ন করছে। তবে এখনও অনেক বিদ্যালয়ে দক্ষ শিক্ষক না থাকায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা সম্ভব হচ্ছে না। মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম থাকলেও ব্যবহারের অভাবে তা নষ্ট হচ্ছে। ফলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকছে এবং ক্লাসে মনোযোগ হারাচ্ছে।
শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য স্কুল-মাদ্রাসা, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন জিনিস খুব সহজেই শিখতে পারছে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান করছেন। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ ও সংরক্ষণের অভাবে ডিজিটাল পদ্ধতির কার্যকর ব্যবহার দেখা যাচ্ছে না। অনেক স্কুলে ব্যবহারিক পরীক্ষাসামগ্রী ছাড়ায় পাঠদান সম্পন্ন হচ্ছে। আবার অনেক স্কুল-কলেজে মানসম্মত পরীক্ষাগার নেই। এতে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে পিছিয়ে পড়ছে।
দুর্যোগে দেশের অনেক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখাকে গতিশীল করতে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করছে। যাদের জন্য এ ক্লাসের ব্যবস্থা তাদের অনেকেরই কম্পিউটার বা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল নেই। যদিওবা কারও কারও এসব সামগ্রী আছে তবুও হয়তো অনেকের ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ বা সামর্থ্য নেই। ফলে যাদের জন্য অনলাইন ক্লাস তারা তেমন কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। যেখানে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অসচ্ছল পরিবার থেকে কোনোরকম পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের জন্য উচ্চ ব্যয়ের অনলাইন ক্লাস সত্যি হাস্যকর। দুর্যোগে অনেক কলেজ স্থানীয় টিভি চ্যানেলে তাদের ক্লাস পরিচালনা করছে। এটি আসলে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাসে কতটা পারদর্শী তার ওপর নির্ভর করছে শিখন কার্যক্রম। তাই, দক্ষ শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে।
কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন শিক্ষা গ্রহণ ও পাঠদানকে সহজ করেছে, ঠিক তেমনি অনেককে এটা বিপদেও ফেলেছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির ব্যবহারে তেমন অভ্যস্ত না বলে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণে তারা অনাগ্রহী। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর বাড়িতে কম্পিউটার না থাকায় তারা পুরোনো পদ্ধতিতে শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী। আবার ডিজিটাল পদ্ধতিতে কনটেন্ট তৈরি ও সংগ্রহ করতে অনেক শিক্ষক আগ্রহী নয়।
ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার মুখ থুবড়ে পড়ছে। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল পদ্ধতি তথা মাল্টিমিডিয়া ব্যবহারের বিকল্প নেই।
শিক্ষার মাধ্যমে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য ডিজিটাল শিক্ষা পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তিবান্ধব। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। গ্রামের কোনো শিক্ষার্থী যেন শহরের শিক্ষার্থী থেকে পিছিয়ে না থাকে এজন্য শিক্ষক বাতায়নের মাধ্যমে দক্ষ শিক্ষক দ্বারা বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করা হচ্ছে। গ্রামের স্কুলে কর্মরত শিক্ষক ডিজিটাল কনটেন্টের সহযোগিতা নিয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা করছেন।
এতে গ্রামের শিক্ষার্থীরাও উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু এখনও গ্রামের অনেক স্কুল শিক্ষক যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে কম্পিউটারের ব্যবহার করতে পারছেন না। তাই এসব শিক্ষকের তালিকা করে অতি দ্রুত ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি ও এর ব্যবহারবিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। এতে শিক্ষকরা দক্ষ হবেন আর শিক্ষার্থীরাও পাবে তথ্যবহুল পাঠ।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সময় পাঠ্যবই পরিবর্তন করা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পাঠদান কেমন হবে, তা অনেক শিক্ষক সহজেই বুঝতে পারছেন না। কোনো একটা বিষয় স্থায়ী হওয়ার আগেই অনেক সময় তা পরিবর্তন করা হয়। এ ধরনের ঘন ঘন পরিবর্তন থেকে বিরত থাকতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানে এখনও এ ব্যবস্থা চালু হয়নি, সেখানে দ্রুত চালুর ব্যবস্থা করতে হবে। আবার চালুকৃত প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী যেন ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধা পায়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যেসব শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অনীহা পোষণ করছেন, তাদের উৎসাহ দিতে হবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাঠ সহজ এবং তথ্যবহুল হয়Ñ তা বোঝাতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার জন্য নায্যতাভিত্তিক ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। বিদ্যালয়ে ও বাড়িতে তথ্যপ্রযুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু জিপিএ ৫ বা পাসের হার বৃদ্ধি নয় বরং শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সব সুবিধা দিয়ে এবং যথাযথ ব্যবহার করে আগামীর ভবিষ্যৎ দেশ গড়ার কারিগর শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই প্রকৃত অর্থে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।