ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মুখোশ পরা মানুষ

মুখোশ পরা মানুষ

কবি হেলাল হাফিজের ‘অশ্লীল সভ্যতা’ নামক মাত্র ছয় শব্দের একটি কবিতা আছে, তা হলো : ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না।’ আসলে মানুষ বোঝা কি খুবই কঠিন? জানা, বোঝা বা জ্ঞান অর্জন করা এগুলোর উৎস কী? যেসব উৎস বা মাধ্যম দিয়ে আমরা কোনো কিছুকে জানি, বুঝি বা চিনি তারইবা নিশ্চয়তা কতটুকু? এসবই দার্শনিক প্রশ্ন। জ্ঞানবিদ্যা (বঢ়রংঃবসড়ষড়মু) নামে দর্শনের একটি শাখা আছে, যেখানে এ নিয়ে অনেক উঁচুমাত্রার তত্ত্বালোচনা করা হয়ে থাকে। আমরা সেই গুরু-গম্ভীর আলোচনায় যাচ্ছি না। খুবই সহজ-সরলভাবে আমরা যদি বিষয়টিকে দেখি তাহলে জানা-বোঝা বা চেনার খুবই প্রাথমিক উৎস বা মাধ্যম হলো অভিজ্ঞতা। আমরা আমাদের চোখ, কান, নাক, ত্বক ইত্যাদি ইন্দ্রিয় দিয়েই প্রকাশিত জগতের বস্তু, বিষয়, ঘটনার জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করি। মানুষকে জানা বোঝা বা চেনার ক্ষেত্রেও সাধারণত এর ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু কোনো মানুষের মুখম-লই যদি ঢাকা থাকে, তাহলে চেনাজানার প্রাথমিক প্রক্রিয়ায়ই তো গলদ বাধে। একটি গানের কথা মনে পড়ল। ছোটবেলায় গানটির অর্থ ও প্রাসঙ্গিকতা আমার কাছে বেশ জটিল বলে মনে হতো। গানটি হলো : ‘ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়/বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়/মুখ ঢাকা মুখোশের এই দুনিয়ায় মানুষকে কি দেখে চিনবে বলো।’ গানটি ‘দস্যু বনহুর’ নামক ছায়াছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে জেনে ছোটবেলায় এই বুঝে সন্তুষ্ট ছিলাম যে, এই কথাগুলো বোধ হয় শুধু ডাকাত বা দস্যুদের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে। কেননা, তারা মাঝেমধ্যে মুখ ঢেকেই তাদের কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু হায়! এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ প্রসঙ্গÑ পরিপ্রেক্ষিত একেবারেই অন্যরকম। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই তো এখন মুখ ঢেকে চলাচল করে, অন্য মানুষের সামনে আসে। এই মানুষের মধ্যে সব শ্রেণির মানুষ আছে। কিন্তু মুশকিলটা ওই জ্ঞানতাত্ত্বিক। এদের চেনার প্রকৃত উপায় কী। মুখোশ পরা মানুষের মধ্যে অনেক পরিচিত ও প্রিয়জনকে চিনতেও আমাদের অনেক ক্ষেত্রে কষ্ট হয়।

একটি বাস্তব ঘটনা বলি। দুই-তিন মাস আগের ঘটনা। কোনো একটি পাবলিক প্লেসে একজন মাস্ক পরা নারী ৭ থেকে ৮ বছরের একটি শিশুকে নিয়ে আমার কাছে দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। হঠাৎ করে সেই নারী আমার সামনে এসে ‘স্যার’ সম্বোধন করে সালাম দিলেন। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার কারণে আমার অনেক ছাত্রছাত্রী আছে। তাই বলে ‘স্যার’ সম্বোধন করলেই যে-কাউকে শিক্ষার্থী মনে করার কোনো কারণ নেই। শিক্ষার্থীদের পরিবারের কেউ এবং পরিচিত অনেকেই এ ধরনের সম্বোধন করেন। যেমন দাড়ি, টুপি, লম্বা পাঞ্জাবি, পাগড়ি পরিধান করা কোনো ব্যক্তিকে অনেকেই ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করে থাকে। আমি আমার কিশোর বয়সে (যখন দাড়ি গজায়নি) একবার আমার সমবয়সী মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত এক নিকটাত্মীয়ের ড্রেস পরে তার অনুরোধে তার সঙ্গে বাইরে গিয়েছিলাম। আমাকে সেদিন অনেকেই ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। এমনকি অনেক মুরব্বি বা বয়সে প্রবীণ মানুষও আমাকে ওই ধরনের সম্বোধন করেছিলেন। সে যাইহোক, আমি ওই নারীকে প্রথমে চিনতে পারিনি, এমনকি আলাপচারিতার বেশ অগ্রসর পর্যায়েও আমি সত্যিকার অর্থে কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। তার বাচনভঙ্গির বিনয় বারবারই শিক্ষার্থী হওয়ার সম্ভাবনাকে সবল করে তোলা সত্ত্বেও, নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে পারছিলাম না। আবার ‘আপনি’ করেও বলতে পারছি না, পাছে শিক্ষার্থী হলে সে কষ্ট পাবেÑ এই ভেবে যে, আমি তাকে চিনতে পারিনি। তাই ‘প্যাসিভ’ প্রক্রিয়ায় কথা বলছিলাম। ‘কোথায় থাকা হয়’, ‘বাবুটি কী হয়’ ইত্যাদি। তবে আমি ঠিকই ধরা পড়ে গেলাম। বুদ্ধিমান সুশিক্ষিত নারী ঠিকই বুঝলেন যে, আমি তাকে চিনতে পারছি না। তাই বরফটি সেই ভাঙল। নিশ্চিত হলাম, সে আমার ছাত্রী এবং অনেক পরিচিত একজন।

এতক্ষণ আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বললাম তা মূলত দৈহিক অঙ্গ হিসেবে ‘মুখ’ ঢেকে রাখা সংক্রান্ত। এ পর্যায়ে একটু অন্যরকম মুখোশ নিয়ে কথা বলব। মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই নিজের চরিত্রকেও ঢেকে রাখার অপকৌশল অবলম্বন করে থাকে। সে যা নয়, তা সাজার জন্য অনেক রকম রাখঢাক অনুশীলন করে। এরাও মুখোশ পরা মানুষ। আমাদের মূল আলোচনা আসলে এদের নিয়েই। এ ধরনের মানুষ সমাজে সংসারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তাদের চেনা কঠিন হয়ে ওঠে। অনেকেই আমরা এসব মুখোশ পরা মানুষের দ্বারা প্রতারিত হই। তবে এরা এমনকিছু ত্রুটিপূর্ণ কাজ করে থাকে, একসময় নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনে। তারা ধরা পড়ে যায়।

মুখোশ পরা মানুষগুলো যে ভয়াবহ বিপজ্জনক কাজটি করতে চান তা হলো, তারা সত্যকে মিথ্যা আবরণে আড়াল করে রাখতে চান। কিন্তু এটা অসম্ভব। সত্য সূর্যের মতো, তাকে হাত দিয়ে আড়াল করা যায় না। সাময়িক কোনো মেঘ সূর্যের আলোকে কিছুটা মøান করে ফেলতে পারে; কিন্তু সে মেঘও কেটে যায়। সত্যের শক্তি অপ্রতিরোধ্য। আর আসল চেহারা বা সত্য রূপ প্রকাশিত হলে মুখোশধারী ব্যক্তিরা মুখোশ পড়ে, এতদিন যে সুবিধা নিয়েছে তার সুদে আসলে খেসারত দিতে হয়। এমনকি তাদের আগামী দিনের অনেক ভালো কাজেরও মূল্যায়ন হুমকির মধ্যে পড়ে। তাই মুখোশধারীদের ব্যবসা সফল হয় না। তারা প্রবলভাবে অসম্মানের জীবন ভোগ করে থাকেন।

তবে মুখোশধারীদের জন্য একটি পজেটিভ নির্দেশনা হলো, যারা বা যে চরিত্রের মুখোশ তারা ধারণ করতে চান তা শুধু ভনিতার মধ্যে না রেখে সত্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা করাই শ্রেয়। কেননা, আপনি যা হওয়ার ভান করছেন, তা যদি আপনি ভালো মনে করেন তবে তা হয়ে ওঠার জন্য চেষ্টা করাই কি আপনার জন্য মঙ্গল নয়? এ প্রসঙ্গে সক্রেটিসের একটি কথা স্মরণীয়। তিনি বলতেন : ‘যা হওয়ার ভান আপনি করে থাকেন তা হয়ে ওঠাই হচ্ছে পার্থিব জীবনে সম্মানজনকভাবে বাঁচার সর্বোত্তম পথ।’ (‘ঞযব এৎবধঃবংঃ ধিু ঃড় ষরাব রিঃয যড়হড়ঁৎ রহ ঃযরং ড়িৎষফ রং ঃড় নব যিধঃ বি ঢ়ৎবঃবহফ ঃড় নব.)’।

আমরা এমন বিষয়ের ভান করি না, যা আমরা অনুমোদন করি না অথবা সম্মানজনক বা লাভজনক মনে করি না। আবেগীয় সম্পর্ক বা একান্ত প্রিয়জনের কাছে আমরা অনেক সময় যে মিথ্যা অনুরাগ অভিমান বা মজা করে থাকি, সেসব বিষয়কে আমি মুখোশের আওতায় ফেলছি না। কেননা, ওইসব ঘটনা নিতান্ত ক্ষণিকের এবং সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মুখোশ উন্মোচনে নিজেই একসময় সচেষ্ট হন। ওই মুখোশ সত্য গোপনের কোনো মন্দ উদ্দেশ্য থেকে নয়।

আমি সেই মুখোশধারীদের কথা বলছি, যারা মুখোশ পরেন নিজের প্রকৃত অবস্থা লুকানোর হীনমন্যতা কিংবা কোনো অশুভ অভিলাষের সংকীর্ণ মানসিকতা থেকে। প্রয়োজনীয় সত্যজ্ঞান হলো, বিষয়গুলো আপনি সজ্ঞানে লুকাতে চান, যা প্রকাশিত হলে আপনি লজ্জা পাবেন, আপনার অমঙ্গল হবে মনে করেন, সেসব অপকর্ম কখনই ঢেকে রাখা যায় না; তা ঢেকে রাখার জন্য যে ধরনের মুখোশই ধারণ করেন না কেন, আপনি একপর্যায়ে ধরা পড়বেনই। আর তখন আপনি প্রকৃতপক্ষে যে রকম সেই অবস্থান থেকেই মানুষ আপনাকে বিচার করবে। এতদিন যে সকল মিথ্যা সম্মান সুযোগ আপনি নিয়েছেন তার মাশুলও আপনাকে দিতে হবে।

অন্যদিকে, আপনি যা সাজার জন্য মুখোশ পরে থাকেন তা; কিন্তু আপনিই ভালো বলে, সম্মানজনক বলে, কল্যাণকর বলেই অনুমোদন করেন। তাই সে বিষয়গুলো মিথ্যা-মিথ্যা অনুকরণ না করে সত্যিকারভাবে অনুশীলন করলেই আপনার জন্য টেকসই মঙ্গল সুনিশ্চিত হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, মুখোশধারী মানুষ যেসব চরিত্রে অভিনয় করে, ওইসব চরিত্র সত্যিকারভাবে অনুসরণের কম-বেশি যোগ্যতাও তার থাকে। তাই অভিনয় না করে সত্যিকারভাবে সৎগুণের অনুশীলন করলেই তো প্রকৃতভাবে সম্মানিত জীবন লাভ করা যায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত