বাংলাদেশ জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যার প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু উন্নয়ন করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে এই দেশকে। প্লাস্টিকের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ তার মধ্যে অন্যতম। কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে মোট ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৭৯ শতাংশ মাটিতে, ১২ শতাংশ পুড়িয়ে এবং মাত্র ৯ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্যই দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। এ বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে মিনারেল ওয়াটার-জুস কোমলপানীয়র বোতল, প্লাস্টিকের পলিব্যাগ ও প্লাস্টিকের চালের বস্তা। অন্যসব দেশের মতো উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বাংলাদেশে পরিবেশগত মারাত্মক হুমকি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের সাগর-মহাসাগরগুলোর ভূমিকা অনেক। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রধানতম নিয়ামক এই সমুদ্র বিপুল জীববৈচিত্র্যের আধারও বটে। কিন্তু মানুষের ফেলা সিগারেটের ফিল্টার থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ব্যাগ, নানা ধরনের মোড়ক, বোতল ও ক্যানে দূষিত হচ্ছে সাগর-মহাসাগর।
জীবনযাত্রা আধুনিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সমুদ্রে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ, প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহারের পর তার বিশাল একটা অংশ চলে যাচ্ছে নদীতে, যা বিপন্ন করছে সেখানকার জীববৈচিত্র্যকেÑ এছাড়া জলযানের ভাঙা অংশ, তেল-মবিল, তৈলজাত দ্রব্যসামগ্রী সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদী ও সাগরে। আজ মাছসহ জলজপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ন্যূনতম অক্সিজেন নেই। প্রতিনিয়ত বাতাসে মিশ্রিত হচ্ছেÑ কার্বন ডাই-অক্সাইড যা প্রাণী বৈচিত্র্যের অস্তিত্বের ওপর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার গাছপালা বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এ প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্যগুলো মাটি-পানির সঙ্গে মিশে মাটির গুণাগুণ নষ্টের সঙ্গে পানিতে থাকা জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। খাল, নদী ও সাগরে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিনের পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আছে, যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সমুদ্রে যে হারে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বাড়ছে এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতের জন্য পৃথিবী মারাত্মকভাবে ভয়ানক হয়ে উঠবে। সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির পর দ্বিতীয় বড় হুমকিটি প্লাস্টিক বর্জ্য। ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা ও রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য অন্যতম। মাটির স্তরে স্তরে প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন বর্জ্য বৃদ্ধির ফলে ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলো সঠিকভাবে পরিপূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না। তাই শুধু পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কৌশলের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে প্লাস্টিক কোনো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। বরং রিসাইক্লিং করে বিপুল অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে। মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির পাশাপাশি প্লাস্টিকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। রিসাইক্লিংয়ের কারণে বর্তমানে প্রতি বছর ডিসিসি এলাকায় বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। ফলে প্লাস্টিক আমদানি হ্রাস পাওয়া ছাড়াও মহানগরীতে ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
রিসাইক্লিং করার ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাওয়ায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রতি বছর ৩ কোটি ৮ লাখ টাকা সাশ্রয় হচ্ছে। রিসাইক্লিংয়ের ফলে দুই-তৃতীয়াংশ জ্বালানি সাশ্রয়, পরিবেশ দূষণ ও পানি ব্যবহার ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা না হলে ভবিষ্যতে ভাগাড়েই পড়ে থাকবে প্লাস্টিক বর্জ্য। আর সঠিক সচেতনতা ও সুব্যবস্থাপনা করা হলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে দেশ। প্রতি বছর মোট আমদানিকৃত ই-পণ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। একটু চিন্তা করলেই এর ভবিষ্যৎ বিপর্যয় ও ভয়াবহতা সম্পর্কে অনুমান করা যায়। তাই উন্নয়নশীল বাংলাদেশের পরিবেশগত ভারসাম্য ঠিক রাখতে সঠিক ও কার্যকর ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কেননা, এটি পরিবেশগত অস্তিত্ব রক্ষায় রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে বিলম্ব করার সুযোগ আর নেই। কোম্পানিগুলোকে রিসাইক্লিংয়ের ওপরে জোর দিতে হবে। এতে কিছু বেকারত্ব কমবে। তাছাড়া পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে রিসাইক্লিংয়ের কারণে জনবহুল ঢাকা শহর কিছুটা হলে বর্জ্যমুক্ত ঢাকা শহরে রূপান্তরিত হবে। তাই আমাদের উচিত কোম্পানিগুলোতে বেশি বেশি বিনিয়োগ করা, এতে করে কোম্পানিগুলো রিসাইকলের ওপর আস্থা আসবে। আমরা আরএসএল কোম্পানিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারি যে, রিসাইক্লিং করে, তারা আজ দেশ সেরা হয়েছে।
পরিশেষে, দেশের পরিবেশ রক্ষায় সুষ্ঠু প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য অবশ্যই আইন প্রণয়ন করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন সঠিক নিয়মে বর্জ্য সংগ্রহের হার বৃদ্ধি উপযোগী ও উন্নত বর্জ্য পরিবহন পদ্ধতি, সঠিক স্থানে ড্যাম্পিং এবং জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি না হয়, এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি কাজে লাগানো। অতএব, পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।
শিক্ষার্থী
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়