ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কিশোর অপরাধ

কিশোর অপরাধ

উঠতি বয়সের ছেলেরা সম্প্রতি দলে দলে বিভক্ত হয়ে নিয়মিত মারামারি করছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ওদের মধ্যে খুনাখুনি পর্যন্ত সংঘটিত হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন নামে এলাকাভিত্তিক নতুন নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ গড়ে তুলেছে কিশোর গ্যাং। আধিপত্য বিস্তার, মাদক সেবন ও বিপণনের স্বার্থে ওদের দলে দলে মারামারি খুনাখুনি লেগেই আছে। ঘটাচ্ছে হত্যার মতো কর্মকা-। কিশোর গ্যাংয়ের কাছে রয়েছে দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি, এমনকি অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র। মুঠোফোন ব্যবহার করে এমনকি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য ও ছবি আদান-প্রদান করে পরস্পরকে হামলার নির্দেশ দিচ্ছে। যে বয়সে বই নিয়ে কিশোরদের স্কুলে যাওয়ার কথা; ঠিক সেই বয়সে ছুরি, চাকু হাতে কিশোররা হত্যাকা-সহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কা- ঘটিয়ে চলেছে। শুধু চুরি, ছিনতাই নয়, শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের সঙ্গে উঠতি বয়সের কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। কিশোর দলের অপরাধের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গোটা সমাজব্যবস্থায়।

একটি সূত্রমতে, গত দশ-এগারো বছরে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত হত্যাকা- বেশিরভাগই কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘঠিত হয়েছে। রাজধানীতে কিশোর গ্যাংয়ের প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ এবং এদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদারের নেতৃত্বে এরা বড় ধরনের চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, যৌন হয়রানি এবং মাদক বিক্রির মতো কাজে যুক্ত হচ্ছে। এর পেছনে কখনও কাজ করে এক শ্রেণির শক্তিশালী সন্ত্রাসী ও অপরাধী চক্র। সন্ত্রাসী চক্রের সদস্যরা দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ছিন্নমূল পরিবারের কিশোরদের অথের্র প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলে টানে আনে। সাহসী ও বুদ্ধিমান কিশোরদের চুরি, ছিনতাইয়ের মতো ছোটখাটো অপরাধের বাইরেও মাদক বিক্রি, অস্ত্র ও বোমা বহনের মতো মারাত্মক কাজে ব্যবহার করা হয়। এ কাজের জন্য ওদের দেওয়া হয় লোভনীয় অঙ্কের অর্থ। অর্থের প্রলোভনে পড়ে কিশোররা এক সময় অপরাধ জগতের স্থায়ী সদস্য হয়ে যায়।

কিশোর গ্যাং দ্বারা পরিচালিত অপরাধ যেন একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিতে যাচ্ছে। ওরা কেউ বখাটে, আবার কেউ স্কুলপড়–য়া। অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের একটি বিরাট অংশ নিম্নবিত্তের। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ছোটবড় শহরে দরিদ্র পরিবারের লাখ লাখ কিশোর বড় হয় অযতœ, অবহেলার মধ্য দিয়ে। ওরা রেলস্টেশনে, লঞ্চ টার্মিনালে, অফিসের বারান্দায়, এমনকি ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটায়। নদীভাঙন ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের নির্মম শিকার দেশের বিভিন্ন এলাকার পরিবারের শিশু-কিশোরদের নিজস্ব কোনো ঠিকানাও নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে ওরা হয় বঞ্চিত। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৫ লাখ শিশু প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে থাকে। লাখ লাখ শিশু হয় অপুষ্টির শিকার। সামাজিক নিরাপত্তা নেই বিত্তহীন পথশিশুদের জীবনে। শিশুকাল থেকে মা-বাবার স্নেহ-মমতা বঞ্চিত হয়ে ওরা পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রতিকূল পরিবেশে অবহেলা, বঞ্চনা এবং নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে এক সময় অপরাধ জগতের অন্ধকারের দিকে পা বাড়ায়। কখনও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। প্রথমে অপরাধ জগতের নবীণ সদস্য হয়ে কালক্রমে শীর্ষস্থানে চলে যায়।

উচ্চবিত্তের পরিবারের কিশোরদেরও কখনও ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অর্থাভাব যেমন একটি কিশোরকে অপরাধ জগতে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি অর্থের প্রাচুর্যও কখনও অনর্থের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাবা-মায়ের অসর্তকতার কারণে এসব কিশোর অসৎ সঙ্গে মেশার সুযোগ করে নিচ্ছে। সেবন করছে দামি সিগারেট, গাঁজা এমনকি ইয়াবা। নেশার ঘোরে ঘটিয়ে চলছে নানা অপরাধ, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ। মা-বাবা, নিকটাত্মীয়কে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করছে না। আকাশ সংস্কৃতির অবাধ প্রবাহের এ যুগে অশ্লীল ভিডিও, ফেসবুক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার তাদের বিপথগামী করে তোলে। অনেক ক্ষেত্রে মাদক ও অস্ত্র বহনের মতো অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত কিশোররা কালক্রমে হয়ে পড়ে মাদকসেবী। পারিবারিক, সামাজিক অনুশাসনের অভাবে বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওরা অঢেল অর্থ ব্যয় করে নেশার পেছনে। পরে শত চেষ্টায় এ থেকে আর তাদের ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে যাওয়া, সামাজিক অবক্ষয়, অস্থিরতা কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। আজকাল অর্থবিত্ত নির্বিশেষে মা-বাবা, অভিভাবক কিশোর সন্তানদের প্রতি যথেষ্ট খেয়াল রাখেন না। পরিবারের প্রায় সবাই জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এত ব্যস্ত থাকেন যে, ঘরে তাদের সন্তানের দেখভালের যথেষ্ট সময়ই পান না। মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার ব্যবহারে ব্যস্ত কিশোর সময় কাটায় এক পরিবার-বিচ্ছিন্ন জগতে। এছাড়া শরীর চর্চা, খেলাধুলার কোনো সময় বা স্থান নেই আজকের সর্বস্তরের কিশোর-তরুণদের। কোনো বিনোদনমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারও সুযোগ নেই ওদের। কৈশোরে মনোজগতের বিকাশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়ে ওরা ধাবিত হয় নিরুদ্দেশ যাত্রায়। কখনও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অর্থের প্রলোভনে কিশোর-তরুণদের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ফায়দা লুটতে ব্যবহার করা হয় কিশোর গ্যাং। পর্দার আড়ালে থেকে যারা এসব কাজ করেন, তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর গ্যাংয়ের অপরাধী কিশোর কখনোই অপরাধ জগতের পঙ্কিল পথ ছেড়ে বেরিয়ে আসরত পারে না। অকালে জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে হয়তো একসময় এর পরিসমাপ্তি ঘটে। আর এর খেসারত দিতে হয় পরিবারকে। গোটা সমাজে পড়ে এর নেতিবাচক প্রভাব। আজকের কিশোর দিনে দিনে বেড়ে পরিণত মানুষ হয়ে গড়ে ওঠে। অনুকূল পরিবেশ পেলে ধীরে ধীরে তাদের মনে চিন্তা-চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে। বিদ্যা-বুদ্ধি-মননে, প্রগতিশীলতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। কিশোর দেহমনের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন শারীরিক ও মানসিক পরিচর্যা, অফুরন্ত আলোকময় পরিবেশ। দেশের অধিকারবঞ্চিত কিশোরদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, বস্ত্র এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ওদের সামাজিক নিরাপত্তা ও বাঁচার অধিকার দিতে হবে। শক্তি বা শাস্তি প্রয়োগ কোনোভাবেই কিশোর অপরাধ দমনের স্থায়ী পথ নয়। এ জন্য সর্বস্তরের শিশুর জন্য সুশিক্ষা দানের ব্যবস্থা নিতে হবে। নিম্নবিত্তের শিশুদের জন্য স্বল্পমেয়াদি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নিতে হবে। গ্রাম-গ্রামান্তরে প্রতিটি নিম্নবিত্তের কিশোরের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টিদান নিশ্চিত করতে হবে। কিশোরদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদন সুবিধা দিতে হবে। ছিন্নমূল কিশোরদের করতে হবে পুনর্বাসন। অপরাধ চক্রে জড়িয়ে যাওয়া কিশোরদের কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার পাশপাশি ওদের সাংস্কৃতিক পরিম-লে উন্নত চিন্তা-চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দলভিত্তিক কিশোর অপরাধ বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। কেননা কিশোর গ্যাংয়ের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের দায় পরিবারের, সমাজের এবং গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার। সবার সম্মিলিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণই সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ নির্মূল করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত