পরিবেশ মনোবিজ্ঞান
মানুষ আর প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্কের এক অদেখা জগৎ
তানভীর মাহতাব আবীর
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে, কেন বেশিরভাগ লোক বারান্দা বা বারান্দা থেকে দর্শনীয় স্থান রয়েছে, এমন হোটেল রুম ভাড়া করতে পছন্দ করেন? যেসব রোগী তাদের হাসপাতালের বিছানা থেকে প্রাকৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পান তারা অন্যদের চেয়ে দ্রুত কেনো সুস্থ হয়ে উঠেন? বা কেন এমন হয় যে, বিষণœতা যখন আমাদের মনে উদ্বেগ নিয়ে আসে, তখন আমরা প্রকৃতির মধ্যে সতেজ হওয়ার উপাদান খুঁজি? প্রকৃতির প্রতি আমাদের সখ্য পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকা নানা উপাদান আমাদের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করে। সবুজ অরণ্যে হাঁটা বা রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে সৈকতের ধারে বেড়াতে যাওয়ার মাধ্যমে সুখ এবং শান্তির অন্তর্নিহিত অনুভূতি জাগ্রত করতে পারাটা নিছক কোনো আধ্যাত্মিক ব্যাপার নয়। প্রকৃতির নির্মল বাতাস কিংবা তার ভুবনমোহিনী সৌন্দর্য আমাদের চিন্তার পথ খুলে দেয়, প্রশান্ত করে অশান্ত মনকে। ‘পরিবেশ মনোবিজ্ঞান’ নামে মনোবিজ্ঞানের বিশেষ এক শাখা এ ব্যাপারগুলো প্রমাণ করার জন্য অনেক এগিয়ে গেছে।
লেখক রিচার্ড লভ তার বিখ্যাত বই ‘লাস্ট চাইল্ড ইন দ্য উডস’-এ ‘প্রকৃতি-ঘাটতি ডিসঅর্ডার’ বিষয়ে ধারণা দিয়েছেন। লুভের মতে, প্রকৃতি-ঘাটতিজনিত ব্যাধি মস্তিষ্কে উপস্থিত থাকাটা ব্যতিক্রম নয়; এটি প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সংযোগ হ্রাস করে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক সুস্থতার উন্নতি করে। এটি আমাদের ভেতর থেকে জীবিত বোধ করায় এবং নগরায়ণ, প্রযুক্তি বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক বিকাশের সঙ্গে আপস করা উচিত নয়। ১৯৫৩ সালে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের সহযোগিতায় একটি আর্কিটেকচারাল স্টাডি প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রকল্পটি উত্তর আমেরিকার মানসিক হাসপাতালের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের জন্য মনোচিকিৎসা, আচরণ বিজ্ঞান, পরিকল্পনা এবং নকশা সংক্রান্ত পেশাগুলোর একাধিক বিশেষজ্ঞকে একত্রিত করে। তারা হাসপাতালের পরিবেশের বিভিন্ন দিক, যেমনÑ আলো, রং, গোপনীয়তা এবং সামাজিক যোগাযোগের জন্য জায়গা তৈরির ওপর মনোনিবেশ করতে শুরু করে এমনভাবে, যেভাবে প্রতিষ্ঠানের দেওয়াল ছাড়িয়ে তত্ত্ব, পদ্ধতি এবং নকশাগুলো প্রভাবিত করতে পারে। এটি পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের নতুন ক্ষেত্রের চিন্তাভাবনা এবং বিকাশে সহায়তা করে, যা মানসিক অসুস্থতা রোধ করতে এবং নগর সংকটের সময়কালে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচারের জন্য নগরীর বিভিন্ন স্থানের কাজ এবং নকশায় অংশ নিয়েছিল। মনোবিজ্ঞানের বিশেষায়িত এ শাখাকে ব্যক্তির আচরণ এবং অর্জিত জ্ঞানের মধ্যে অভিজ্ঞতা এবং তাত্ত্বিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়। সারা বিশ্বেই এ বিষয়টি নিয়ে সময়ের সঙ্গে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। পরিবেশ মনোবিজ্ঞান ধারণার ইতিহাস অবশ্য খুব বেশিদিন আগের নয়। ১৯১১ সালে উইলি হ্যালপেক নামে পোল্যান্ডের এক মনোবিজ্ঞানী সর্বপ্রথম পরিবেশ মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দেন। তিনি পরিবেশের দুই বা ততোধিক উপাদান বা ঘটনার সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন, যেগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে ষাটের দশকে কাজ শুরু হলেও এখনও স্বাধীন এবং পদ্ধতিগত জটিলতায় পরিবেশ বিজ্ঞানের এ শাখাটি স্বতন্ত্র হতে পারেনি। পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয় এগন ব্রুনসিক এবং কার্ট লিউইনকে। যদিও এ দুজনের এ বিষয়ের ওপর এমন কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ নেই, যেটি পরিবেশ মনোবিজ্ঞানে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যথেষ্ট, তবুও ভৌত পরিবেশের সঙ্গে মনোবিদ্যা এবং মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যোগসূত্র সম্পর্কিত তাদের ধারণাগুলো পরবর্তী সময়ে পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের বিস্তৃতিতে অবদান রেখেছে।
ব্রুনসিক বিশ্বাস করতেন, শারীরিক পরিবেশ মানুষের সচেতনতার বাইরে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করে। তিনি এমন গবেষণার পক্ষে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন, যেখানে পরিবেশের সব দিক অন্তর্ভুক্ত করে ব্যক্তিকে বোঝার চেষ্টা করা হবে। লিউইন ভৌত পরিবেশের পরিবর্তে সামাজিক বা আন্তর্জাতিক প্রভাবগুলোর প্রতিই মনোযোগী ছিলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের তার এই ভাবনাগুলোকে প্রসারিত করতে অনুপ্রাণিত করতেন। তার দুই ছাত্র বার্কার এবং ব্রোনফেনব্রেনার পরবর্তী সময়ে পরিবেশগত মনোবিজ্ঞানের অগ্রদূত হিসেবে অবদান রাখেন।
সেই সময়ে খুব ধীরগতিতে বিষয়টি নিয়ে চর্চা হতো। বেশিরভাগ গবেষণাই হতো বিভিন্ন ধরনের পরিবেশ কীভাবে মানুষের উপলব্ধি এবং আচরণকে প্রভাবিত করে সেসব নিয়ে। তাই সে সময় শাখাটি ‘আর্কিটেকচারাল সাইকোলজি’ হিসেবেই আলোচিত ছিল।
পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের দ্রুত বিকাশের পালাবদল শুরু হয় ১৯৬০-এর শেষের দিকে যখন মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হতে শুরু হয়েছিল। এর ফলে স্বাস্থ্যকর এবং পরিবেশগত আচরণের ব্যাখ্যা এবং পরিবর্তন সম্পর্কিত টেকসই পরিবেশ নিয়ে অধ্যয়ন শুরু হয়।
সাম্প্রতিককালে এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে। ভারতীয় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মধুলিনা রায় চৌধুরী নেদারল্যান্ডসভিত্তিক মনোরোগবিষয়ক এক ওয়েবসাইটে লেখা এক ব্লগে এমন কিছু গবেষণার উল্লেখ করেছেন।
১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন এবং অস্ট্রেলিয়ার মনোবিজ্ঞানীদের একটি দল অনুসন্ধান করেছে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনগুলো মানুষের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে তা নিয়ে। ফলাফলগুলো ইঙ্গিত দেয়, ২২ থেকে ২৪ ডিগ্রি অবধি তাপমাত্রাসহ একটি মাঝারি জলবায়ুতে যারা বাস করে, তারা মিশ্রতা, উন্মুক্ততা, বহির্মুখী রূপান্তর এবং সম্মতির মতো ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোতে ভালো ফল দেখিয়েছে।
২. বিজ্ঞানী রায়ান ল্যাম্বার, মাইলস রিচার্ডসন, ডেভিড শেফিল্ড ২০১৭ সালে তাদের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, প্রকৃতির নিকটবর্তী হওয়া ইতিবাচক আবেগকে উসকে দেয়। বহিরাগত ক্রিয়াকলাপ, যেমনÑ পাহাড় বেয়ে ওঠা, বাগান করা বা পাখি দেখা, প্রকৃতির সঙ্গে মনের সম্পর্ক দৃঢ় করে এবং সুখের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।
৩. অধ্যাপক হেলেন লকহার্ট তার এক গবেষণায় ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে এক আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, যেটি সামাজিক-পরিবেশগত সংকটের ফলে আজ হুমকির মুখে পড়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ এবং বন উজাড়ের মতো ঘটনাগুলো স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের মতো বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর জন্য ক্রমেই হুমকি হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সমস্যার মূলে রয়েছে মানুষের আচরণ।
পরিবেশগত এসব সমস্যার বিপরীতে মানুষের আচরণ পরিবর্তন করার উপায় সন্ধান করে একই সঙ্গে মানুষের মঙ্গল ও জীবনমানের পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে পরিবেশ মনোবিজ্ঞান। সেই লক্ষ্যে মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, হচ্ছে বিস্তর গবেষণা, বাড়ছে এই ক্ষেত্রের সম্ভাবনা। আগামী দিনগুলোতে আমরা হয়তো পরিবেশ মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেশকে বুঝতে পারার পথটাকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারব, পরিবেশগত জটিলতা আর মানুষের স্বার্থপর মনোভাবের দূরত্ব কমিয়ে বাসযোগ্য এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখব আগামী প্রজন্মের জন্য।
তানভীর মাহতাব আবীর
শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
