ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ : একটি বিশ্লেষণ

‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ : একটি বিশ্লেষণ

উন্নয়ন একটি ধ্রুপদি ধারণা। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ এখন সরকারের যে কোনো ইতিবাচক পরিকল্পনা ও কর্মসূচিকে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনের লক্ষ্য মনে করে। ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। এটি একসময় সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের তথাকথিত হ্ইাপোথ্যাটিক্যাল ধারণার পরিবর্তে প্রযুক্তিরির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার মাধ্যমে বাস্তবধর্মী কর্মপরিকল্পনার সূচনা করেন। যাকে ডিজিটাল ধারণা বলা হয়। ২০১০ থেকে ২০২১ সালের পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনায় দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২১) বাস্তবায়নের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের যুগপৎ যাত্রা শুরু করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদও। উন্নয়নের কৌশলকে তিনি অবিভাজ্য (টহরভরবফ) নীতিতে বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে সামাজিক উন্নয়নের পরিধিতে ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন ফলে কার্ল মার্কসের অর্থনীতির উপরি কাঠামো এতদিন যেটি শ্রেণিকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেটি এখন শেখ হাসিনার প্রযুক্তিনির্ভর ‘উন্নয়ন মডেল’ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে, যা ‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ হিসেবে চিহ্নিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ভেবেছেন প্রযুক্তিগত জ্ঞান ছাড়া অর্থনীতির সুফল জনগণের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কারণ জনগণ যদি অর্থের ব্যবহার তার শিক্ষা স্বাস্থ্য কিংবা লাভজনক চিন্তায় (অধিৎবহবংং) বিনিয়োগ করতে না পারেন তাহলে সে অর্থ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে না। অর্থনীতিবিদ কার্ল মার্কস বলেছিলেন উৎপাদনের (কৃষি অর্থনীতি বা ইধংরপ ংঃৎঁপঃঁৎব) ওপর উপরিকাঠামো বা ঝঁঢ়ঢ়বৎ ংঃৎঁপঃঁৎব টিকে থাকে। কার্ল মার্কসের এই তত্ত্ব সাধারণ জনগণের কাছে একটি ধ্রুপদি ধারণা বৈ কিছু নয়।

বিশে^র যেসব দেশ উন্নয়নের শিখরে পৌঁছেছে তাদের শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসার ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সহজ হয়েছিল শিল্প বিপ্লবের সহায়ক উপাদানলভ্যতার কারণে, যা বাংলাদেশের জন্য অকল্পনীয়। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ মাত্র ৫০ বছরে যে জায়গায় দাঁড়িয়েছে, তা শুধু সম্ভব হয়েছে ‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ এর কারণে।

বাংলাদেশে শিল্পায়নের ব্যাপক সুযোগ ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ফলে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ ছিল একটি দরিদ্র জনপদের নাম। কষ্টসহিষ্ণু মানুষের দুর্বল রোগাগ্রস্ত শরীর আর হাওর-বিল জলাভূমি নদীনালা অধ্যুষিত একটি ভূখ- ছিল ব্রিটিশ শাসনামলের বঙ্গভূমি। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির মেরুদ- ছিল মহাজন জমিদার আর মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির দখলে।

ফলে কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল, হাজং আর টংক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কৃষির সঙ্গে নিয়েজিত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। ১৯৫০ সালে প্রণীত হয়েছে জমিদার প্রথা বিলুপ্তি আইন। কৃষক আর কৃষি শ্রমিকের স্বাধীনতা, ভূমির দখল পরিবর্তন হয়েছে। জমির উর্বরতা থাকলেও উৎপাদনে ঐতিহ্যগত চাষাবাদ পদ্ধতি, আধুনিক ধারণার অভাব এবং অশিক্ষার ফলে উৎপাদন বাড়েনি লক্ষ্যমাত্রায়। এতে অভাব দরিদ্রতা পিছে পিছে চলেছে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হয়ে আসা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা আরও ভয়ংকর। যে রাজনৈতিক দর্শন ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পূর্ববাংলা আত্মপ্রকাশ করল তার নেতিবাচক ফল পেয়ে গেল ১৯৪৮ সালেই মাত্র ১ বছরের মাথায়। পূর্ব বাংলার ভাষার প্রশ্নে দেখা দিল শঙ্কা। বাঙালির ভাষা, যা হাজার বছরের ঐতিহ্য নিয়ে চলে এসেছিল তাতে বাদ সাধলেন পাকিস্তানের কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বয়ং। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, গোলাম মোহাম্মদ, ইসকান্দার মির্যা, চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং মুহাম্মদ আলীসহ যারাই পাকিস্তানের মসনদে বসেছে, তারাই পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার কৌশল করেছে এবং জনগণকে রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত করেছে। আদমজি জুট মিল এবং কর্ণফুলী কাগজের মিল ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানে উল্লেখ করার মতো কোনো শিল্প কলকারখানা ছিল না, যা ছিল তা কিছু পাট ক্রয় কেন্দ্র (কুঠি, গুদাম আর পাটজাত পণ্যের কারখানা)। এসব পাটজাত পণ্যের কুঠিগুলো গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ আমলে ভারতের বাওয়ানি আদমজি ও বিহারিদের দ্বারা। সরকারি চাকরি, প্রতিরক্ষা, পুলিশ এবং প্রশাসনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। পাকিস্তানের ২৪ বছর অর্থনীতির শোষণ আর অধিকার বঞ্চনার ইতিহাস। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ফলে ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল, তা ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম।

একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশে ফিরে এসে একটি কপর্দকহীন অর্থনীতি পেয়েছিলেন। উপরন্তু পাকিস্তানের কাছে প্রাপ্য ৫০০ কোটি ডলার অর্থফেরত পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব বড় বড় প্রকল্পের অর্থ যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। যার অর্থের জোগান বঙ্গবন্ধুকে দিতে হয়েছিল। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল বিধ্বস্ত, অফিস-আদালত ছিল কর্মঅযোগ্য। তবুও বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের বাংলাদেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে রাতদিন পরিশ্রম শুরু করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল ৮৮ ডলার, যা ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। অর্থনীতির এমন অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সরকার লাখ লাখ বেকারকে চাকরি দিয়ে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন, শিল্প-কলকারখানা চালুকরণ, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ে তোলা ছিল চ্যালেঞ্জ। ১৯৭৩-৭৪ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৮২ শতাংশ এবং ১৯৭৫-৭৬ সালে ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকারের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করতে, সে সময় জাসদ ও পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি নানাভাবে অপতৎপরতা চালিয়েছে।

তারপরও মাত্র সাড়ে ৩ বছরের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান, বিচারপতি সাত্তার, জেনারেল এরশাদ এবং বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট দ্বারা শাসিত বাংলাদেশের উন্নয়ন নীতি ছিল বিদেশি ঋণনির্ভর ও দলীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সমর্থকদের কল্যাণ। একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সহজ হবে স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল মাত্র ৫ হাজার মেগওয়াট আর ‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’-এ ২০০৯ থেকে গত ১১ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ২০ হাজার মেগওয়াটের বেশি। গত ১০ বছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে ৬ শতাংশের বেশি। কোভিড-১৯ কারণে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হলেও ২০১৫ থেকে ২০১৯ জিডিপি বেড়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। লক্ষণীয় বিষয় হলো একই সময়ে ভারতে এ হার ছিল ৬ এবং পাকিস্তানে ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দাঁড়িযেছে এখন ২ হাজার ৫৫৪ ডলার আর অর্থনীতির আকার ৪০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যার টাকার হিসেবে ৩৫ লাখ কোটি টাকার বেশি। পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণিক বিদ্যুৎ উৎপান প্রকল্পসহ এরকম মেগা প্রকল্প দেশের অর্থনীতির চাঙাভাবকে মনে করে দেয়। দেশের অর্থনীতির এই অগ্রগতির সঙ্গে সামাজিক অগ্রগতিও হচ্ছে সমান্তরাল গতিতে। জনগণের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। প্রতিহাজারে শিশু মৃত্যুহার ৩১ অথচ ৯০-এর দশকে এ হার ছিল হাজারে ১৪৪। এমডিজি (সহশ্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) সফলতার সঙ্গে পূরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা) পূরণে এরই মধ্যে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছে।

‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেলে’ দেশে দারিদ্র্যের হার এখন ২০ দশমিক ৫। অর্থনীতির সঙ্গে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ সরকারের ২৯টি বিভাগ সমন্বিতভাবে কাজ করছে। এ মডেলে যেসব কর্মসূচি চলমান রয়েছে সংক্ষেপে তা হলোÑ বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, অতিদরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি), গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার, দরিদ্র মা’র জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, জটিল রোগীদের আর্থিক সহায়তা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, পোশাক শিল্প শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা তহবিল, অনাথ আশ্রম কর্মসূচি, প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের উপবৃত্তি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের উপবৃত্তি, হিজড়া, বেদে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উপবৃত্তিসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।

‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ একটি প্রযুক্তিনির্ভর সমন্বিত মডেল। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো আজ বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ সফলতার একমাত্র উদ্ভাবক জননেত্রী শেখ হাসিনা। উন্নয়নের ধ্রুপদি তত্ত্বকে শেখ হাসিনাই শুধু প্রায়োগিক মডেল হিসেবে বাস্তবতার নিরিখে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যেখানে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও অর্থ একসঙ্গে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণাকে পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। আর যখন তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তখনই উন্নয়নের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এটি উন্নয়নের রাষ্ট্র মডেলের সঙ্গে সাদৃশ্য। ‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’-এ গত নভেম্বরে (২০২১) বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটেছে। আগামী দিনে এসডিজি, অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সমন্বিত কর্মসূচি যুগপৎভাবে সম্পাদিত হলে সারা বিশ্বে ‘শেখ হাসিনা উন্নয়ন মডেল’ অনুকরণীয় ও ব্যাপকভাবে সমাদৃত হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত