ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১২ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বুড়িগঙ্গা : সেকাল একাল এবং আগামীকাল

বুড়িগঙ্গা : সেকাল একাল এবং আগামীকাল

পৃথিবীর ইতিহাস বলে সর্বত্রই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করে। নদী মানুষকে সভ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে। এসব নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল হাজারো জনপদ। তেমনি নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক নগরী ঢাকা। মুঘল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার বয়সও ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। এ নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক নগরী। পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। শিল্পায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ এ নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য সবগুলোর শেষ ঠিকানা এ বুড়িগঙ্গা। প্রতিনিয়ত প্রায় ৩ কোটি মানুষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। ঢাকা মহানগর ও কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যরে একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। অপরিশোধিত বর্জ্যরে প্রতিটি ফোঁটা এ নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্রমাগত দূষণে এর পানি এখন কালচে আকার ধারণ করেছে। কালো রঙের পানি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানির দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়াই কষ্ট হয়ে পড়ে। নদীর পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা। এর সঙ্গে বিশ শতকের নতুন আবিষ্কার পলিথিন দূষণের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নদীতে। নদীর এই ভয়াবহ অবস্থার জন্য দায়ী ঢাকা নগরীর মানুষ।

আগেকার দিনে মানুষ একটু প্রশান্তির জন্য বুড়িগঙ্গায় বেড়াতে যেত। নৌকা করে পাড়ি দিত এপার-ওপার। এসময় নদীর জল দু’হাতে ভরে ছুড়ে দিত আকাশের দিকে, গায়ে মাখত। বালকরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ত নদীর জলে। আর শঙ্খচিলের দল ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াত। মাছরাঙাটি ছোঁ মেরে লুফে নিত তার শিকার। মাঝি-মাল্লার মুখে ফুটে উঠত গান। জেলেদের মুখে ফুটত হাসি। কী সুন্দরই না ছিল সেসব দৃশ্য! কিন্তু বর্তমানে বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াই মুশকিল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে, বেড়ে গেছে বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ। এ বিষাক্ত পদার্থ আর ভারি ধাতুর অভয়ারণ্যের মধ্যে কোনো জলজপ্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। মাছ তো দূরে থাক, সাধারণ অন্য কোনো জলজপ্রাণীর অস্তিত্বও চোখে পড়ে না এ নদীতে। শুধু তাই নয়, বুড়িগঙ্গার পরিবেশ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর। বুড়িগঙ্গার আজকের এ করুণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ন। এ অপরিকল্পিত নগরায়ন থেকে সৃষ্টি অপরিকল্পিত শিল্পায়ন। যার কারণে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এবং উঠছে বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানা। আবার ঢাকা শহরের মানুষের সব বর্জ্য ফেলা হয় এ নদীতে। শহরের ড্রেনগুলোর সঙ্গে যেন এ নদীর আছে এক আন্তঃসম্পর্ক।

যে নদীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে ঢাকা শহর, সেই নদী আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অনেক শিল্পকারখানা, তার ওপর যুক্ত হয়েছে অবৈধ দখলদারিত্ব। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার অবস্থা এখন নাজুক। নদী হয়ে গেছে সংকুচিত। আর যেটুকুই বা আছে, তা ভরে আছে সব বিষাক্ত পদার্থে। এ বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে তুলতে দরকার সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতা। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের জমা হওয়া বর্জ্য অপসারণ করতে হলে হাতে নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। উদ্যোগ নিতে হবে ঢাকার অন্য নদীগুলোর সঙ্গে বুড়িগঙ্গার সংযোগ সারা বছর নাব্য রাখার। নদীতীর দখলমুক্ত করে জনসাধারণের জন্য হাঁটাচলার রাস্তা তৈরির সঙ্গে লাগানো যায় দেশীয় প্রজাতির গাছ। সরকারের সদিচ্ছা ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে দীর্ঘমেয়াদে বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। দিন দিন ইট-পাথরের জঙ্গল হয়ে ওঠা ঢাকাকে সুন্দর ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে বুড়িগঙ্গার হারানো রূপ পুনরুদ্ধারের বিকল্প নেই। মনে আশা জাগে, আবারও এই বুড়িগঙ্গায় দেখা দিবে জোয়ার-ভাটা, জীবকূল ফিরে পাবে প্রাণ, মাছরা ঝাঁকে ঝাঁকে করবে খেলা, মাছরাঙাটি ওতপেতে বসে থাকবে শিকারের আশায়, জেলেদের মুখে ফুটবে হাসি, মাঝি-মাল্লার মুখে ফুটে উঠবে গান, শঙ্খচিলের দল ডানা মেলে উড়বে স্বাধীনভাবে, ক্লান্ত বিকেলে বালকরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়বে নদীর জলে, সবুজে-সবুজে ভরে উঠবে নদীর দুই তীর, আর কবি-সাহিত্যিকের কলম হয়ে উঠবে অস্ত্রের থেকেও ধারাল। সেই বুড়িগঙ্গাকে দেখতে পারব কি-না জানি না, তবে এই আশা আমাদের।

শিক্ষার্থী

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

md.almamun.86.jnu.bd@gmail.com

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত