ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

বাঙালি জাতির সংগ্রামমুখর ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন অত্যুজ্জ্বল এক গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের এ ভূখ-ে ঘটে যাওয়া এ আন্দোলনের শোকাবহ পরিণতির কথা আমরা বছরের এ বিশেষ দিনে স্মরণ করি। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাঙালির জাতীয় চেতনা সুসংহত করা, বাঙালি সংস্কৃতির স্বকীয়তা শনাক্ত করা, সর্বোপরি বাঙালির আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে কৌতূহলী করে তোলা এসবই তো একুশের কাছ থেকে পাওয়া। এমনকি এ বিষয়েও কোনো ধরনের বিতর্কের অবকাশ নেই, বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ যে অর্জন মহান স্বাধীনতা, তার ভিত্তি মূল প্রোথিত ছিল এ একুশের চেতনার মধ্যেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি প্রতিটি বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির গৌরব ও বেদনার ইতিহাস। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় তরুণ সমাজকে জীবন দিতে হয়েছিল বলে দিনটি বেদনায় নীল। পক্ষান্তরে ভাষা আন্দোলনের পথে বাঙালি তার স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে বলে এ দিনটি জাতীয় জীবনে একান্ত গৌরবের। বুকের রক্তঝরা ওই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয়েছে বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে প্রেরণাদীপ্ত একুশে ফেব্রুয়ারি অসাধারণ তাৎপর্য বহন করে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ভাগের পর বাংলা ও বাঙালির প্রতি যে অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি, ভাষা আন্দোলন ছিল তারই একটি প্রবল প্রতিবাদ। শাসকের স্টিম রোলারে পিষ্ট করেও তা থামাতে পারেনি। বাঙালি জাতীয়তাবোধের চেতনা থেকে উৎসারিত সে আন্দোলন ক্রমে ক্রমে ধাবিত হয়েছিল স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে। অবশেষে বাঙালি সফল হয়েছে। স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির যে চেতনা আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে সাহায্য করেছে, সেই দিনটিকে শুধু আনুষ্ঠানিক নয়, প্রজন্মান্তরে বুকে ধারণ করতে হবে। বাঙালি জাতির নিজস্ব ভূখ- স্বাধীন বাংলাদেশ আজ শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নানা শাখা-প্রশাখায় এগিয়ে চলেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এ এগিয়ে চলা বিরামহীনভাবে চলবে এবং বিশ্বসভায় একদিন বাঙালি জাতি গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হবে।

আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মদানের এ দিবসটি বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ২১ ফেব্রুয়ারি এখন শুধু আমাদের ভাষাশহীদ দিবস নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসও বটে। মাতৃভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমা ব্যপ্ত হয়েছে, পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজ নিজ মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও বিকাশের বিষয়টি তাদের রাজনৈতিক অধিকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। আমাদের এ দেশেও সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা প্রকাশের সুযোগ অবারিত রাখা প্রয়োজন।

ভাষা মানুষের জীবনে অতি মূল্যবান সম্পদ। পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত কয়েক সহস্র ভাষার মধ্যে বাংলা একটি অন্যতম প্রধান ভাষা। নিজস্ব সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার থাকার পরও যুগে যুগে নানা ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় শব্দসম্ভার নিয়ে বাংলা ভাষা উৎকর্ষ লাভ করেছে। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের পরিচয়ের প্রধান বাহন মাতৃভাষা। ভাষা যে কোনো জাতির মেধার অনন্য লালন ক্ষেত্র। জাতির মননের আকর্ষণীয় স্থাপত্য। সমগ্র বিশ্বে প্রায় সব ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকা এ রকমই হয়ে থাকে।

ভাষাবিজ্ঞানীদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জানা যায়, ভাষার জন্ম হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৫ লাখ বছর আগে। বর্তমানে পৃথিবীতে ৬৭০০-এর অধিক ভাষা প্রচলিত আছে। বর্তমান শতকেই সবচেয়ে বেশি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ প্রতি এক সপ্তাহে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

সভ্য মানুষের কাছে মাতৃভাষা হলো দ্বিতীয় মা। যে কোনো জাতির আত্মপরিচয়ের মধ্যে তার মাতৃভাষা খুবই মূল্যবান। একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হচ্ছে ভাষা। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী কার্যকর মাধ্যম। মাতৃভাষার প্রচলন শুধু ভাষাগত বৈচিত্র্য, বহুভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না, তা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুধাবন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অবদান রাখবে। প্রতিটি মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া, বিশেষ করে দুর্বল ও জীর্ণ মাতৃভাষাগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং দুর্বল বলে কোনো ভাষার ওপর প্রভূত্ব আরোপের অপচেষ্টা না করাই হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য। প্রত্যেক ভাষাভাষী মানুষ এদিনে নিজের মাতৃভাষাকে যেমন ভালোবাসবে, তেমন অন্য জাতির মাতৃভাষাকেও মর্যাদা দেবে। পৃথিবীর সব মানুষের মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর দিন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এভাবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে বুকে ধারণ করে মাতৃভাষাকে ভালোবাসার প্রেরণা পাবে মানুষ।

একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীক। ১৯৫২ সালের আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার। অথচ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বাংলাদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, আর্ন্তজাতিক যোগাযোগ, কর্মসংস্থান ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাভাষা রীতিমতো প্রান্তিক ভাষায় পরিণত হয়েছে। অথচ কথা ছিল, অন্যান্য ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করে মানুষের পাঠ উপযোগী করে তোলা হবে সব বই। প্রথমদিকে সে উদ্যোগ চোখেও পড়ে। পরবর্তী সময়ে তা ঝিমিয়ে পড়ে। বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, তার বাস্তবায়ন তেমন চোখে পড়ে না।

যদিও দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ আগে জাতিসংঘ কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ভাষা সংগ্রামের এত সাফল্য এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও সমাজ-রাষ্ট্রের সর্ব পর্যায়ে বাংলাভাষার প্রচলন ও ব্যবহারে আজও আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। এখনও অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায়, বিদেশি ভাষার ব্যবহার। আমরা জাতি হিসেবে আবেগতাড়িত হয়ে সবই আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জন করতে পারি; কিন্তু এর সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে যেন এতটা আগ্রহ বোধ করি না। যেখানে রাশিয়া, চীন ও জাপানের মতো দেশ তাদের মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। শিল্প ও সাহিত্য চর্চাসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তারা গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা আমাদের দেশে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারছি না। অথচ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সর্বস্তরে মাতৃভাষা ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। তারপরও আমরা তা ব্যবহারে সর্বজনীন হতে পারছি না। বাংলা ভাষাচর্চা যেন এখন শুধু ফেব্রুয়ারি মাসকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা বাংলাভাষাকে নিয়ে অসম্ভব রকম বাড়াবাড়ি করে থাকি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস শেষে সারা বছর যেন তা বেমালুম ভুলে যাই। ভাষা সত্তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, এর চর্চা বাড়ানোর জন্য, শুদ্ধভাবে ভাষাচর্চার জন্য, ভাষা বিষয়ে গবেষণা করার জন্য আমাদের আরও অনেক বেশি আন্তরিক হওয়া উচিত।

মাতৃভাষার চর্চা ও বিকাশের ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে আছি, যা ভাষা আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রজ্ঞাপন-বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেটি করা সম্ভব বলেও অনেকে মনে করেন না। এ জন্য প্রত্যেকের ব্যক্তিগত উপলব্ধিকে শাণিত করতে হবে, পরিভাষা-অভিধানসহ সম্ভাব্য সব উপকরণ সহজলভ্য করার মাধ্যমে ভাষাচর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে, এ বিজাতীয় মনমানসিকতা থেকে বিনাপ্রয়োজনে বিদেশি ভাষা ব্যবহারের অপচেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। যদি সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু না হয়, তবে একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।

এর আদর্শ, এর শিক্ষা অধরাই থেকে যাবে, যা কোনো আত্মতুষ্টির বিষয় হতে পারে না।

আমাদের সমাজে মাতৃভাষার চর্চার প্রতি অবজ্ঞা থেকে উত্তরণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন, প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা। কেননা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত ভাষার স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। কোনোভাবেই বাংলাকে ইংরেজির বিপরীতে দাঁড় করানো উচিত হবে না। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য ইংরেজি এবং আমাদের সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ, দেশ, মা-মাটি প্রভৃতিকে চিরঞ্জীব করতে বাংলা ভাষাচর্চা প্রয়োজন। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাষাকে সমৃদ্ধ না করলে আমরা সমৃদ্ধ হতে পারব না। ভাষার সঙ্গে উন্নয়নের রয়েছে গভীর যোগাযোগ। চীন-জাপান-ফ্রান্স-জার্মানি এ ক্ষেত্রে আমাদের উদাহরণ হতে পারে। কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনÑ সর্বত্রই আমরা দেখি তাদের জনগণের ভাষা যথেষ্ট গুরুত্ব ও কার্যকারিতা নিয়ে জোরালোভাবে টিকে আছে।

আমাদের মাতৃভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ আরও ব্যাপকভাবে বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। কবি, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দার্শনিক তথা কলম কারিগররা মাতৃভাষায় তাদের সুনিপুণ লেখনীর আঁচড়ে কাব্য, সাহিত্য ও বিভিন্ন মতবাদ রচনা করেছেন এবং যথাযথ সম্মানও পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী প্রাণ পুরুষ মাইকেল মধূসুদন দত্ত মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে ব্যর্থমনোরথে ফিরে এসে পুনরায় বাংলা ভাষায় কলম ধরে সফলকাম হয়েছিলেন।

ভাষা আন্দোলনের মহান অর্জন সমুন্নত রাখতে, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে চিরজাগরুক রাখতে নারী-পুরুষ, তরুণ-যুবক তথা সব বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেষ্ট থাকতে হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের সীমানা পেরিয়ে সমৃদ্ধির দ্বারে প্রবেশ করতে। আর আমাদের অবিরাম সংগ্রাম করে যেতে হবে একটি সমৃদ্ধশালী ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে, যাতে থাকবে না ধর্ম-বর্ণ-দল-মতের বিভেদ। পৃথিবীতে মাতৃভাষার সম্মানরক্ষার জন্য আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনা বিরল। এ জন্য জাতি হিসাবে আমরা গর্বিত।

সেই গর্ব, সেই অহংকার নিয়ে বাংলা ও বাঙালির ভাষাগত ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাসকে এগিয়ে নেওয়ার সার্বক্ষণিক চেষ্টাই করতে হবে আমাদের। আর তার মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মানপ্রদর্শন করা সম্ভব বলে আমরা বিশ্বাস করি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত