রাজধানী তো বটেই, দেশের প্রতিটি শহরেই যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা বর্জ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর মধ্যে আবার মেডিকেল বর্জ্য স্বাস্থ্য ও পরিবেশ উভয়ক্ষেত্রেই মারাত্মক প্রভাব রেখে চলছে। সূত্র মতে, দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে, তার প্রায় ২০ শতাংশই মেডিকেল বর্জ্য। দেশের ১৫টি সরকারি হাসপাতালেই প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে ২১ টনের বেশি বর্জ্য। সাধারণ অর্থে বলা যায়, চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় যেসব বর্জ্য তৈরি হয়, তাদের বলে মেডিকেল বর্জ্য। এক গবেষণার ভিত্তিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক বলছে, করোনাকালে শুধু কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী থেকে প্রতিদিন ২৮২ দশমিক ৪৫ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার পুরোটাই গৃহস্থালি বর্জ্যরে সঙ্গে অপসারণ করা হয়। ২০২০ সালের মে মাসে শুধু ঢাকাতেই ৩ হাজার টন মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মেডিকেল বর্জ্য কতটা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সে বছরের ২০ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে এ গবেষণাটি করা হয়। কিন্তু দৈনিক তৈরি হওয়া এত বিপুল পরিমাণ মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো কার্যকর উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি ৩৫টি জেলার সরকারি হাসপাতালে। ফলে বাড়ছে হেপাটাইসিস-বি ও হেপাটাইসিস-সি, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া এমনকি এইডসের মতো রোগের প্রকোপও। বিষয়টি শঙ্কাজনক।
দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অবস্থা খুবই নাজুক। গবেষণার তথ্যানুযায়ী, দেশের চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোয় যে বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার মাত্র ১৪ দশমিক ১ শতাংশ সঠিক নিয়মে ব্যবস্থাপনার আওতায় ছিল। সেসবও মাত্র একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অপসারণ ও শোধন করা হয়। বর্জ্য আলাদা করার ব্যবস্থাপনা থাকলেও তা বিনষ্ট বা শোধন করার নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাপনা নেই অধিকাংশ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের। এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের বরাতে প্রকাশ, দেশের ৩৫টি জেলায় এ পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। দেশের অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে হাসপাতাল বর্জ্য পরিশোধনের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, এমনকি এইডসের মতো মরণব্যাধির ঝুঁকি বাড়ছে। দৈনিক যে পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হয় তার ৮০ শতাংশ সাধারণ গৃহস্থালি বর্জ্য আর ২০ শতাংশ মেডিকেল বর্জ্য। এ ২০ শতাংশ মেডিকেল বর্জ্য কোনো না কোনোভাবে ৮০ শতাংশ সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে যায়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকায় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। শুধু সরকারি হাসপাতাল নয়, বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলোতেও বর্র্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল নয়।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সব সরকারি হাসপাতালে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালেও সঠিক নিয়মে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি আধুনিক ও সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন, অর্থায়ন এবং তা বাস্তবায়ন জরুরি। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ এক করে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। এ সমস্যার মোকাবিলায় চারটি বিষয়ে জোর দিতে হবে সচেতনতাকে অভ্যাসের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, সবার উদ্যোগের সমন্বয়, ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা অর্জন, টেকসই সমাধানের কৌশল নির্ধারণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মিলে এ সমন্বয়ের পদক্ষেপ নিতে পারে। সমন্বিত কর্মপন্থায় টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে এটাই প্রত্যাশা।