ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আধিপত্যবাদের স্বরূপ ও বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা

আধিপত্যবাদের স্বরূপ ও বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা

ধনী বা পরাক্রমশালী রাষ্ট্রগুলো সাধারণত গরিব বা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের বলয় বা নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি বা কার্য উদ্ধার করতে চায়। এজন্য এসব রাষ্ট্র রাজনীতি, কূটনীতি ও সমরশক্তি ব্যবহার করে তাদের নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে থাকে। এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ সারা বিশ্ব শাসন ও শোষণ করত, এখন বিভিন্ন পরাশক্তি নানা কৌশলে তাদের আধিপত্যের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা ও তার ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্ররা ইউক্রেনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করে পেছন থেকে সটকে পড়েছে এবং তারা যুদ্ধে না জড়িয়ে রমরমা অস্ত্র ব্যবসা শুরু করছে। অনেকে বলছেন, এটা আধিপত্যবাদের একটা নয়া কৌশল ও রূপ।

মূলত আমরা সবাই আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা মোড়লিপনা শব্দগুলোর সঙ্গে কমবেশি পরিচিত। মূলত এসব শব্দের মাধ্যমে সাধারণত এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করা বোঝায়। নিজের কর্তৃত্ব বা শ্রেষ্ঠত্ব যেকোনো উপায়ে বজায় রাখার একটি কৌশল। সহজ ভাষায় বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মোড়লিপনা করা বা খবরদারি করা। এর মাধ্যমে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে আধিপত্য বিস্তারের কৌশল বেছে নেওয়া হয়। এটি যেমন প্রতিটি দেশে সামাজিক শৃঙ্খলাকে বাধাগ্রস্ত করে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিম-লেও আধিপত্যবাদ প্রভাব বিস্তার করে। আজকের বিশ্বায়নের যুগে বিশ্বে এটি নতুন কোনো ধারণা নয়।

বিশ্ব আধিপত্যবাদকে এক দেশ বা এক দল জাতির দ্বারা বিশ্ব মোড়লিপনা হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিশ্ব আধিপত্য রাজনৈতিক, আদর্শিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক বিষয়গুলোর সঙ্গে কাজ করে। রোমান সাম্রাজ্যে প্রাথমিকভাবে সামরিক শক্তি ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; স্পেনীয় সাম্রাজ্যে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছিল; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ডোমেইন বাণিজ্যিক পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয়; অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিংশ শতাব্দীতে কমিউনিজম বিস্তারের জন্য কাজ করেছিল। চীন বাণিজ্যিক স্বার্থে তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। অন্যদিকে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ব্লকের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো ন্যাটো জোটের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সশস্ত্র সংঘাতের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি প্রভাব বিস্তার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন বা যুদ্ধ মূলত ন্যাটোর সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেন চেয়েছিল, ন্যাটোর সদস্য হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে; কিন্তু রাশিয়া দেখল ন্যাটো জোটের শক্তি তাদের নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। এ কারণে ইউক্রেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছে। ইউক্রেন যাতে ন্যাটোতে যোগ দিতে না পারে, সে জন্য এ যুদ্ধ শুরু করেছেন ভøাদিমির পুতিন। কিন্তু এর ফলে হয়তো তার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ন্যাটো জোটে সদস্য সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে হয়তো ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটো জোটে যোগ দিতে পারে।

বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন এসব দেশ নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে মরিয়া। অনেকে এ পঞ্চ বৃহৎ শক্তিধর দেশকে পঞ্চভূত বলে অভিহিত করে থাকে। এ আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা আজ থেকে শুরু হয়নি। প্রথম শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বিভিন্ন দেশ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে তারা প্রযুক্তির বিকাশ সাধনের ফলে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে। সেই সময়ে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলো তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে ছিল। প্রথম দিকে এসব খুব বেশি প্রভাব বিস্তার না করলেও ধীরে ধীরে শক্তিমত্তার বিস্তার ঘটতে থাকে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নিত্যনতুন অস্ত্র আবিষ্কারের শুরু সেই তখন থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। সেক্ষেত্রে স্নায়ুযুদ্ধকালে ঘটনাকে স্মরণ করা যেতে পারে। আধিপত্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে আমরা উপনিবেশবাদের সঙ্গেও পরিচিত।

অথচ এক সময় মানুষে মানুষে মূল দ্বন্দ্ব ছিল রাজ-রাজাদের মধ্যে, অর্থাৎ কে কত বেশি রাজ্য ও ধনসম্পদ জয় করতে পারে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের রাজ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে মনুষ্য প্রজাতি অন্যদের হত্যা করত। এরপর এসেছে মতবাদ বা আদর্শগত দ্বন্দ্ব। কে কোন আদর্শের, কে কোন মতবাদী, কে কোন ধর্মের ইত্যাদি! আদর্শগত দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পর পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পশ্চিমাদের বিজয় পৃথিবীকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। পৃথিবী কীভাবে চলবে, এ আদর্শ নিয়ে চলছে পর্দার অন্তরালে কূটনীতি ও জটিল রাজনীতি! কার মতবাদ অধিকসংখ্যক মানুষ মেনে নেবে, তা যেন হয়ে উঠেছে মুখ্য, এতে পুরো মানব প্রজাতির ওপর কী প্রভাব, তা নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ বা মাথাব্যথা নেই। আদর্শের জায়গা থেকে তাদের নিষ্ঠুর আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা! কার চেয়ে কে কত বড় ও ক্ষমতাধর সে প্রতিযোগিতায় এখন পৃথিবী ব্যস্ত; কিন্তু প্রান্তিক মানুষগুলো যেমন ছিল, তেমনই থেকে গেছে, পৃথিবীর আধিপত্যকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষ ক্ষমতার মহড়া দেখাতে পারলেও, সেই ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ছে অসহায় মানুষ, ক্ষতিটা হচ্ছে পৃথিবীর ক্ষমতা না বোঝা নিরীহ নিরপরাধ মানুষেরই।

আধিপত্য বা সাম্রাজ্যবাদ প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করে নিজস্ব ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের ওপর। আর ক্ষমতা বলতে বোঝায় আর্থিক সামর্থ্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন, কূটনৈতিক পারদর্শিতা এবং আধুনিকায়ণ, যা অন্য দেশের থেকে এগিয়ে থাকে এবং উন্নত অবকাঠামোর সমন্বয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীজুড়ে বহু বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। বলাবাহুল্য, এক্ষেত্রে মার্কিন প্রযুক্তি, শক্তিশালী আর্থিকভিত্তি, স্বার্থবাদী কূটনীতি এবং দক্ষ রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য একসময় সারা বিশ্ব শাসন ও শোষণ করত। তবে প্রভাব বিস্তারের প্রধান নিয়ামক যে ক্ষমতা তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমাদের সামাজিক পরিম-লেও যাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বেশি, তারাই বেশি প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাদের সিদ্ধান্তই মেনে চলতে হয়। বিশ্ব পরিম-লেও একই অবস্থা। উন্নত ক্ষমতাধর দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। আধিপত্যবাদে অন্যকে নিজের আয়ত্তে রাখা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজের পক্ষে মতামত দেওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আজ বিশ্বজুড়ে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের খেলায় মত্ত ক্ষমতাশালী দেশগুলো। এসব দেশের রয়েছে আধুনিক অস্ত্রসম্ভার, কারিগরি দক্ষতা, প্রযুক্তির আধুনিকায়ণ ইত্যাদি। তারা যুগ যুগ ধরে নিজেদের স্বার্থবাদী আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টা করছে।

পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো, এমন ইস্যুই খুঁজে থাকে, যার মাধ্যমে কোনো জাতিকে নিজের স্বার্থে নিঃশেষ করা যায়, পরাভূত করা যায়। যার মধ্য ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণিভেদ, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ ইত্যাদি অন্যতম। বর্তমান বিশ্বের সংঘাতগুলোর দিকে তাকালে এমন সব চিত্রই চোখে পড়ে, ক্ষমতাধর মানুষ এসব সংঘাতপূর্ণ দিকগুলোর দিকেই মাছরাঙার মতো চোখ রাখে, যার পরিপ্রেক্ষিতে করাল থাবায় প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের, আর তারা নিজেদের আরও ক্ষমতাধর মনে করতে থাকে। নিজেদের দুর্বলতাগুলো নিজেরাই প্রকাশ করে দেয়, একই সীমানায় বসবাস করে, সেই সীমানার বিরুদ্ধেই আঙুল তোলে, যার কারণে অনেকের দুর্বল ভিত্তি জেনে আঘাত করা সহজ হয়ে যায় প্রতিপক্ষের। বর্তমান পুঁজিবাদ একই রাষ্ট্রের ভেতর একাধিক গোষ্ঠী সৃষ্টি করছে, কেউ কাউকে নিজের মনে করতে পারে না, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যতা বোধ পিছিয়ে দিচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে, আর ফায়দা লুটছে এসব মোড়ল। আধিপত্যবাদী শক্তিধর দেশগুলো বিরোধের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে, যাতে সেখানে বিরোধ লেগেই থাকে, এমন কলাকৌশলে পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছেই রেখেছে, পরোক্ষভাবে এখনও এ পৃথিবী উপনিবেশবাদের মধ্যেই রয়েছে। এক ধরনের জালে আটকে আছে ক্ষমতাহীন মানুষ, যেভাবে টেনে তুলবেÑ ঠিক সেভাবেই উঠতে হচ্ছে সবাইকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মিত্রশক্তি। যুদ্ধের পরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ দুই দেশ ঠান্ডা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, যা অব্যাহত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধ এখন চলছে চীনের সঙ্গে মূলত বাণিজ্য নিয়ে। অন্যদিকে ইউক্রেন আক্রমণ করে ইউরোপে ‘গরম’ যুদ্ধ আবার ফিরিয়ে আনল রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের মতো করে একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সেই ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ জানানো শুরু করে মূলত চারটি দেশ। যেমনÑ চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। এসব দেশ আমেরিকার কর্তৃত্ববাদী আধিপত্যবাদ মানতে চরমভাবে অনিচ্ছুক। এ রকম এক অবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত শুধু এ দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা বিশ্ব অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত হানবে এবং বিশ্বের আধিপত্যবাদ নতুন মেরুকরণ তৈরি করবে।

বিশ্বায়নের যুগে পৌঁছালেও, মুক্তির যুগে আমরা এখনও প্রবেশ করিনি। সমাজ, দেশ, সভ্যতার পায়ে এখনও শেকল। এ শেকলের প্রতিটি জোড়ায় আছে, ধর্ম, বর্ণ, আধিপত্য, সম্পদ। এই শেকল যতদিন না খুলবে, মানবজাতির বৃহৎ একটি অংশ রয়ে যাবে অন্ধকারে, আর রাজত্ব করবে অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ। কে জানে আজ থেকে হাজার বছর পর হয়তো, সেই আধিপত্যবাদ মানুষের বংশধররাই নতুন নামে টিকে থাকবে, আর ক্ষমতাহীন মানুষগুলোর কাঠামোই থাকবে জাদুঘরে, তখন তারা ইতিহাসের বিষয়বস্তু করবে আমাদের যে, এ নামে কিছু একটা পৃথিবীতে ছিল। এখনই সচেতন হওয়া উচিত, না হয় আমাদের ভুলেই আমরা বিলীন হয়ে যাব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত