সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ফেইসবুকের টাইমলাইন, নিউজফিড অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রচার বর্তমান সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। যা আমাদের তরুণদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে ফেইসবুক ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত তরুণ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অশ্লীল চ্যাট, শেয়ার, ভিডিও কল তরুণ ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এক নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নারীর অশ্লীল শরীরের চিত্র ও ভিডিও প্রচার এবং তা দর্শন করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অশ্লীল অবাস্তব প্রত্যাশা, ঝুঁকি, আচরণের অস্বাভাবিককরণ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক প্রভাব নিয়ে আসছে। এতে নারীরা বিশেষ করে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, কিশোর-কিশোরীদের ওই বয়সে মানসিক স্বাস্থ্য বিকশিত হতে থাকে এবং ব্যক্তি হিসাবে তাদের নিজস্ব পরিচয় বিকাশ লাভ করে। বয়ঃসন্ধিকাল ঝুঁকি গ্রহণের একটি সময়, যা একদিকে শক্তি এবং দুর্বলতা উভয়ই। সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেইসবুকের অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রচার তরুণ প্রজন্মের মানসিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে। যেমন আমরা বর্তমানে তরুণদের অপরাধপ্রবণতার বৃদ্ধি দেখেছি।
ড. শ্যারন কুপার, ফরেনসিক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং নর্থ ক্যারোলিনা স্কুল অফ মেডিসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি সদস্য, বলেছেন ‘ছবি অবশ্যই কিশোর-কিশোরীদের প্রভাবিত করে’ এবং কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্ক পর্নোগ্রাফি থেকে অস্বাস্থ্যকর যৌন ছবি গ্রহণ করে? ড. কুপারের মতে, পর্নোগ্রাফি যৌনতাকে অস্বাভাবিক করে তোলে এবং অরক্ষিত যৌন যোগাযোগ, সহিংসতা এবং ধর্ষণের মতন ঘটনাকে উৎসাহিত করে। ডা. কুপার যুক্তি দেন, কিশোর-কিশোরীরা পর্নোগ্রাফিক ইমেজগুলোর জন্য বেশি ঝুঁকিতে থাকে কারণ মস্তিষ্কের মিরর নিউরনগুলোর কারণে। কিশোর-কিশোরীরা কীভাবে শিখে তাতে মিরর নিউরন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুতরাং পর্নোগ্রাফি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে। এরফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে দেখা প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে পাবলিক প্লেসে নারী ও মেয়েদের যৌন হয়রানির বৃদ্ধির সোশ্যাল মিডিয়া ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অশ্লীল ছবি নারীদের যৌন বস্তু হিসেবে দেখাতে ভূমিকা রাখচ্ছে এবং তরুণ প্রজন্মের যৌন আচরণকে প্রভাবিত করছে। তরুণদের সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ফেইসবুকের অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও দেখা ভবিষ্যতের যৌন আচরণ এবং মনোভাবকে প্রভাবিত করে। যা নারীদের প্রতি আগ্রাসী হতে এবং অবজ্ঞা করতে প্ররোচিত করে। যা তাদের শেখাতে পারে যে আক্রমণাত্মক আচরণ করা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এবং এমনকি কাম্য। যা নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এবং আচরণকে আকার দেয়। ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, ফেইসবুক এবং ইউটিউবে যৌনতাযুক্ত ছবি এবং সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত থাকা, কিশোর-কিশোরীদের আচরণ এবং মনোভাবের ওপর নেতিবাচক বা অস্বাস্থ্যকর প্রভাব ফেলছে।
তরুণরা সামাজিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি কিশোর-কিশোরীরা অবাস্তব ‘হালকা-পাতলা’ বা ‘পেশীযুক্ত’ শরীরের ধরনগুলো অনুসরণ করে, তবে তা তাদের ডায়েটিং আচরণের ওপর প্রভাব ফেলবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা তাদের স্বাস্থ্য এবং জীবনধারা সম্পর্কে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, উদাহরণস্বরূপ জাঙ্ক ফুড খাওয়া, ধূমপান, অ্যালকোহল পান এবং অন্যান্য মাদক গ্রহণ। সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন প্রাক-কৈশোর এবং কিশোর-কিশোরীদের কেনার প্রবণতাকেই প্রভাবিত করে এবং তাদের মতামতকেও প্রভাবিত করে?
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন রাজনীতিবিদ, পাবলিক ফিগার বা সেলিব্রিটি সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য ‘ভুয়া খবর’ বা পক্ষপাতদুষ্ট বা ঘৃণাপূর্ণ মনোভাব প্রচার, সাইবার বুলিং ইচ্ছাকৃতভাবে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করে অন্য ব্যক্তির সম্পর্কে বা সরকারের সম্পর্কে বা কোনো বিষয়ে মিথ্যা, বিব্রতকর বা প্রতিকূল তথ্য দিয়ে সব কিশোর-কিশোরীদের ভুলপথে চালিত করছে।
বর্তমানে ফেইসবুক ডিপ্রেশন বা ‘ফেইসবুক বিষণœতা’ যা কিশোর-কিশোরীদের বিষণœতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিশোর-কিশোরীরা ফেইসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া সাইটগুলোতে প্রচুর সময় ব্যয় করার ফলে বিষণœতার লক্ষণগুলো প্রকাশ করে। অফলাইন বিষণœতার মতো, প্রাক-কৈশোর এবং কিশোর-কিশোরীরা যারা ঋধপবনড়ড়শ বিষণœতায় ভোগে, তারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকিতে থাকে এবং কখনও কখনও আক্রমণাত্মক বা আত্ম-ধ্বংসাত্মক আচরণ করতে। কিশোর-কিশোরীদের বিকাশমান মস্তিষ্কই অনলাইনে অনেক বেশি সময় থাকার ফলে বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করে। সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার সামাজিক কার্যকলাপ হ্রাস এবং একাকিত্ব বৃদ্ধিসহ বিষণœতার লক্ষণগুলো তীব্রতর করে। সোশ্যাল মিডিয়ার দীর্ঘায়িত ব্যবহার হতাশা, উদ্বেগ এবং কম আত্মসম্মানবোধের লক্ষণ ও উপসর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিশোর-কিশোরীরা প্রায়ই তাদের সামাজিক মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোতে আবেগগতভাবে পোস্ট করার তাড়না অনুভব করে। তারা অনলাইনে দ্রুত সাড়া পাওয়ার চাপ অনুভব করে। তারা নিখুঁত ফটো এবং ভালো লিখিত পোস্টের জন্য চাপ অনুভব করে, যার সবগুলোই অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ হয়। প্রকৃতপক্ষে, একজন কিশোর-কিশোরীর সামাজিক বৃত্ত অনলাইনে যত বড় হয়, তারা অনলাইনে সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ব্যাপারে তত বেশি উদ্বেগ অনুভব করে। ফলস্বরূপ, এটি কিশোর-কিশোরীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা উদ্বেগের অনুভূতি সৃষ্টি করে। অনেক কিশোর-কিশোরী, বিশেষ করে মেয়েরা, অন্যরা তাদের সম্পর্কে কী ভাববে এবং তারা যখন তাদের পরবর্তী সময়ে দেখবে, তখন তারা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।
কখনও কখনও কিশোররা সোশ্যাল মিডিয়াতে এত বেশি ঘণ্টা ব্যয় করে যে, তারা মূল্যবান ঘুম হারাতে শুরু করে। ফলস্বরূপ, এ ঘুমের ক্ষতি মেজাজ, গ্রেড হ্রাস, শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং অতিরিক্ত খাওয়ার পাশাপাশি বিষণœতা, উদ্বেগ এবং মনোযোগের ঘাটতি হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (অউঐউ)-এর মতো বিদ্যমান সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলে। যেমনÑ ফোকাস করতে অসুবিধা, মানসিক নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল মনোযোগ, হাইপারঅ্যাকটিভিটি এবং পর্যাপ্ত ঘুম। সুতরাং, মধ্যরাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় লগইন করা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর।
উপসংহারে বলতে হয়, সরকারকে সোশ্যাল মিডিয়ায় বা ফেইসবুকের টাইমলাইন, নিউজফিডে অশ্লীল সংবাদ, ছবি, ভিডিও প্রচার প্রদর্শনী বাংলাদেশে বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। পিতামাতাদের উচিত তাদের তরুণ ও কিশোর-কিশোরী সন্তানদের সামাজিক মিডিয়ার ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা ও পরামর্শ দেওয়া এবং অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহার করা হলে তাদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে তাদের সতর্ক করা। শিক্ষার পাঠ্যক্রমটিও সংশোধন করা উচিত যাতে শিক্ষার্থীদের সতর্ক করা যায় যে, তাদের সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার।