ঢাকা বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে

বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই পরিবেশ এবং পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বায়ু। বেঁচে থাকার জন্য আমরা বায়ুর ওপর নির্ভরশীল। বিশুদ্ধ বায়ু ছাড়া পৃথিবীতে কোনো জীবের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব না। কিন্তু কিছু ক্ষতিকর পদার্থ বাতাসে মেশার ফলে বায়ুদূষিত হচ্ছে। যার ফলে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা নিজেরাই কখনও নিজের স্বার্থের জন্য বা উন্নয়নের জন্য পরিবেশের এ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দূষিত করছি ।

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। মূলত বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-২.৫-এর পরিমাণ দেখে তালিকাটি করা হয়েছে। ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০-এর কম। বর্তমানে এ দূষণের পরিমাণ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যা বলার মতো না। ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদনে আবারও বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। আইকিউআরের প্রতিবেদনে আমরা উদ্বিগ্ন হলেও আমরা বিস্মিত না। কেননা, ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম । শুধু দেশ হিসেবে নয়; নগরী হিসেবে আমাদের রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত স্থান হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। ঢাকার বায়ুমান কেমন সেটা নাক-মুখ ও চোখ দিয়েই বুঝা যায়, এ জন্য গবেষণাগারে পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না। বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে যদি ‘হটস্পট’ এর কথা চিন্তা করি, তবে প্রথমে চলে আসে রাজধানী ঢাকার কথা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে ঢাকায়। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব কিছুই ঢাকামুখী হওয়ার জন্য ঢাকাকে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যার ফলে ঢাকার বায়ু ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণের একটা বড় কারণ হলো রাজধানীর বর্জ্য। রাস্তাঘাটে যেখনে-সেখানে উন্মুক্ত বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায় এবং প্রকৃতিতে খোলা অবস্থায় প্লাস্টিকসহ ময়লা পোড়ানো হয়, যার ফলে বায়ুদূষিত হয়। বায়ু গবেষকরা বলছেন, সড়কে পড়ে থাকা ময়লার বড় অংশ থাকে প্লাস্টিক, যা পোড়ানোর কারণে ডাইঅক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলের মতো বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া কার্বন-ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অন্তত ছয়টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়, যার ফলে বায়ুদূষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণের একটি প্রধান কারণ হলো নির্বিচারে বনজঙ্গল কেটে ফেলা। আমরা আমাদের প্রয়োজনে গাছ কাটছি; কিন্তু পরে আর কোনো গাছ রোপণ করি না। এর ফলে বায়ুতে কার্বন-ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বেশি হয়ে এবং বায়ুদূষণ হচ্ছে। ঢাকা নগরীতে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন মেগা ও মাঝারি উন্নয়ন কর্মকা- চলছে। ব্যাপক নির্মাণ কাজের জন্য বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ফলে বায়ুদূষণ হচ্ছে।

বাংলাদেশেজুড়ে আমরা বায়ুদূষণের একই চিত্র দেখতে পায়। গ্রামে যে দূষণ হচ্ছে, তা এমনটা নয়। কেননা, যদি শহরের বায়ুদূষণই যদি হত, তবে পর পর বাংলাদেশর নাম শীর্ষে আসত না। এছাড়া একটি প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি বায়ুর মান, মাত্রার চেয়ে অনেক খারাপ। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে ১০টি জেলার বায়ুর মান।

বায়ুদূষণের একটি প্রধান কারণ হলো ইটখোলা নির্মাণ। কোনোরকম নিয়ম না মেনেই তৈরি করা হচ্ছে ইটখোলা। অবাধে ব্যবহার করা হয় ড্রাম চিমনি। মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। এছাড়া রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি দেখা যায়, যার ফলে বায়ু আরও বেশি দূষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। দূষিত বায়ুতে আমাদের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। দূষিত বায়ু আমাদের শরীরে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে থাকে। বায়ুদূষণের কারণে হাঁপানি, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যাসহ বহুরোগ হয়। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। এক পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণ এর ফলে যে শুধু আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বায়ুদূষণের ফলে ওজনস্তর পাতলা হচ্ছে, যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে ভয়াবহ দাবানল, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক সংবাদ পৌঁছাচ্ছে। আমাদের দেশে বিনিয়োগ কম হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হব। বায়ুদূষণের দৈনিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা মোট বিশ্ব উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ। বায়ুদূষণ হলো সেøাপয়জন; কিন্তু বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আমরা সচেতন না। বায়ুদূষণের ফলে যে রোগ হচ্ছে, সেগুলো আমরা দ্রুত অনুধাবন করতে পারি না। আমরা বায়ুদূষণকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। শুধু বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। গতবছর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশর মানুষের গড়আয়ু কমেছে ৫ বছর ৪ মাস। আইকিউএয়ার-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে চীনের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি সম্প্রীতিক বছরগুলোতে প্রকট থাকলেও তারা এর মধ্যে উন্নতি করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এখনও নীরব কেন?

বায়ুদূষণ রোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা বায়ু, পানিসহ পরিবেশগত নানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের খুব কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখি না, যার ফলেই একটি দেশ বারবার দূষণে শীর্ষে। ২০১৯ সালে নামমাত্র ‘নির্মল বায়ু আইন’ করা হয়েছিল, যার কোনো কার্যক্রম আমরা দেখতে পায়নি। তাই নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং আইন যেন কাগজে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেইদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে। বর্তমানে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত জনজীবনের চিত্র গণমাধ্যম এবং পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলেও এটা এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। প্রশাসন এবং জনগণ কেউই সচেতন নয়। বায়ুদূষণ রোধে জনসচেতনতা খুবই জরুরি। দূষণ রোধ করার জন্যে নগরায়নে সুষ্ঠপরিকল্পনা দরকার। শিল্প-কারখানা থেকে যেন বায়ুদূষণ না হয়, তাই পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা নির্মাণ করতে হবে। নির্বিচারে গাছকাটা বন্ধ করে বনায়ন করতে হবে। ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। দূষণরোধ করার জন্য সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা যেকোনো দূষণ রোধ করতে পারে; কিন্তু শুধু সচেতন হয়ে এখন দূষণ রোধ করা সম্ভব না। পরপর চার বার বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছি, আমরা দূষণরোধে এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বায়ুদূষণ রোধ করার জন্য এখনই সুষ্ঠু পরিকল্পনা করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দূষণরোধ করতে স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে, তবেই আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে পারব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত