‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণাদায়ক এক অনন্য অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। সেই বিবেচনার আলোকে ‘জয় বাংলা’ আজ আমাদের জাতীয় স্লোগানের মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছে। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসের খেরোখাতায় অমর বাণী হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকলেও এই স্লোগানকে বিজাতীয় ভাষা মনে করে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জয় বাংলাকে নির্বাসনে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। জয় বাংলা, একটি অনুভূতি ও আবেগের ভাষা হলেও এর চিরন্তন আবেদনই আমাদের স্বাধীনতা তথা মুক্তির ঠিকানা খুঁজে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ উপমহাদেশে বাঙালি ও বাংলা ভাষার মর্যাদাকে নিয়ে দারুণভাবে ছেলেখেলা হয়েছে। শতাব্দী পর শতাব্দী শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে বাঙালি। আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত বাঙালি জাতির মৌলিকত্ব খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। মোগল আমলের পরে দুইশত বছরেরও বেশি সময় ব্রিটিশরা এ অঞ্চলের অধিকর্তা হিসেবে বাঙালির ওপর চরম অপশাসন চাপিয়ে দিয়েছিল। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কশাঘাতে আমরা ছিন্নভিন্ন জাতি হিসেবে বসবাস করছিলাম। ব্রিটিশরাজদের দাসত্ব থেকে মুক্তির প্রয়াসে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাঙালিরা শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিলেও ব্রিটিশরাজমুক্ত বাংলাদেশে বাঙালিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে ভারত-পাকিস্তান নামে তিন খ-ে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ব্রিটিশদের কূটচালে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হলেও ভারত অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে।
কিন্তু পাকিস্তান সাম্প্রদায়িকতাকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। মূলত এটা ছিল ইংরেজদের ষড়যন্ত্র। স্থায়ীভাবে একটা সমস্যা জিইয়ে রেখে রক্তপাতহীন বিনাযুদ্ধে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করে যায়। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলের বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিতের হার ছিল খুবই কম। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে মুসলমানদের পরিচিত ছিল বিশ্বব্যাপী। তদানীন্তন শিক্ষিত কতিপয় মুসলিম ব্যক্তিত্ব মুসলিম লীগ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
ইংরেজি শিক্ষা ইসলাম ধর্মবিরোধী কিংবা হারাম বলে বিশ্বাস করে মুসলমানরা পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীতে রূপান্তর হয়। এমনি পরিস্থিতিতে মুসলীম লীগ নামের যে সংগঠনটি গড়ে ওঠে, মূলত সে সংগঠনই মুসলমানদের অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে চিহ্নিত হয়। তরুণ শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তার ব্যক্তিত্ব ও কর্মকুশলতা ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তিনি হয়ে ওঠেন সংগঠনের মধ্যমণি। এক পর্যায়ে মুসলিম লীগ হয়ে যায় আওয়ামী মুসলীম লীগ। শেখ মুজিব স্বাধীন পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতিকে গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করতে শুরু করেন।
তিনি স্পষ্টত উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তানে বাঙালি জাতি শোষিতের জনগোষ্ঠী হিসেবে বেড়ে উঠছে। পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙালি হলেও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। শেখ মুজিব তার তরুণ তুর্কিদের নিয়ে সংগ্রাম গড়ে তোলেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ গঠন করেন। অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ গ্রহণ করেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। বাঙালির মুক্তির নিশানা হয়ে যায় আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবকে ঘিরে। তার যোগ্যতার বলেই তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হন। পাকিস্তানের ঊষালগ্নেই অর্থাৎ ১৯৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। কেননা স্বাধীন পাকিস্তানে উর্দু ভাষাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হলে বাঙালি ছাত্র সমাজ এর প্রতিবাদ করে। এ থেকেই শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ সৃষ্টি হলে পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আন্দোলন দমনে রাজপথে অস্ত্র ব্যবহার করে বেশ কিছু তাজা প্রাণ কেড়ে নেয়, ২১ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়।
এ দিনটি শহীদ দিবসের মর্যাদা লাভ করে। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে গৌরান্বিত হয়। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে স্বাধীনতা তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৬৯ সালে ৬ দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলনে গণঅভুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব শাহির পতন ঘটে যায়। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন। দীর্ঘ সংগ্রামণ্ডআন্দোলন করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বহুবার কারাগারে যেতে হয়। ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে ক্ষমতার পথ বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তানি আরেক স্বৈরশাসক আইয়ুব শাহির উত্তরসূরি ইয়াহিয়া খান বাঙালির ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাতে থাকে। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ সর্বজনীন হয়ে ওঠে। বাঙালির হৃদয়ে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানটি গ্রথিত হয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে এক কাব্যময় ভাষণে চূড়ান্ত যুদ্ধের রূপরেখা প্রণয়ণ করেন।
রাজনৈতিক নানা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১২টায় বঙ্গবন্ধু তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ২৬ মার্চ থেকে। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চের রাতেই বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলার আকাশে-বাতাসে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান ধ্বনিত হয়। আবালবৃদ্ধাবনিতা সব শ্রেণির মানুষ সাহসী স্লোগান ‘জয় বাংলাকে’ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ৯ মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হাসতে হাসতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে বাঙালি। দলমত নির্বিশেষে সবারই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল শক্তির উৎস।
তেজদীপ্ত অগ্নিরশ্মির স্লোগান ‘জয় বাংলা’ মহান অমৃত বাণী। যুদ্ধে বিজয়ের পর এই ধ্বনির রেশ সারা বিশ্বের মানব হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য জাতির, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তোলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে চেতনাকে ধ্বংস করে পরাজিত গোষ্ঠী অবৈধভাবে বাংলার মসনদ দখল করে। জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে। আমাদের সৌভাগ্য এই যে, জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। শেখ হাসিনা-রেহানা বাঙালির ঠিকানা হিসেবে চিহ্নিত হলে রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশেও সর্বজনীন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে ধরে রাখে শক্তির উৎস ধারায়। আওয়ামী লীগ ব্যতীত সব সংগঠনই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে উপেক্ষা করতে থাকে। স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি হিসেবে দাবিদার সিপিবি, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দলসহ সবাই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ব্যবহার থেকে বিরত থাকে। ফলে এই স্লোগান হয়ে যায় একক আওয়ামী লীগের। কিন্তু এ স্লোগান শুধু আওয়ামী লীগের একক সম্পদ নয়।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটি প্রমাণ করে দিয়েছেন। ৭৫-পরবর্তী ২১ বছর পর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন রাজনৈতিক নানা কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে। তার প্রায় পাঁচ বছর শাসনকাল ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাল। তিনি সেটা করে একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে হারিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি প্রেতাত্মার ক্ষমতায়ন ঘটে। সে শাসনেরও পতন ঘটে ‘জয় বাংলার’ কাছে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ টানা ১৩ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। এ সময় অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এ সবই হয়েছে জয় বাংলার শক্তির কারণে। এমন সাহসী উদ্যম স্লোগানকে কে দাবিয়ে রাখতে পারে? জনতার এই স্লোগান জনতাকেই দেওয়া হয়েছে ফিরিয়ে। আমাদের সংস্কৃতি ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় আঘাতকারীদের এই বাংলায় কখনও ঠাঁই হবে না। বাঙালি জেগেছে নতুন করে। ‘জয় বাংলা’ আজ সবার মুখে মুখে, পরাজিত হওয়ার আর কোনো ভয় নেই। প্রকৃতিগতভাবেই ‘জয় বাংলা’ আমাদের বাঙালির মনোজগতের অবিস্মরণীয় শক্তির বাণী। এই বাণী যারা এখনও উপেক্ষা করে রাজনীতি করছে, তারা কোনোদিনই সফলকাম হতে পারবে না। কারণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছাড়া গোটা জাতির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ভালোবাসার সম্পর্ক না থাকলে মূল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে সব সময়। ‘জয় বাংলা’ জয় বঙ্গবন্ধুই আমাদের আগামী দিনের সম্ভবনাকে লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে। ‘জয় বাংলা’ শুধু একটি স্লোগান নয়-এটি বাঙালির আত্মা।