সন তারিখ ও বঙ্গাব্দের জন্মকথা

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত

প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সন-তারিখ মানে সময়ের ব্যাপার। সময়ের ব্যাপার মানে সময়ের হিসাব রাখার বিষয়। সময়ের হিসাব মানেই তো মাপার ব্যাপার। এ এক কঠিন বিষয়। মানুষ কবে থেকে কীভাবে সময় মাপতে শুরু করেছে, এ তথ্য সঠিকভাবে আমাদের কারুরই জানা নেই। আমরা অনুমান করতে পারি মাত্র, প্রকৃতির অরূপই মানুষের বিস্ময়কে জাগ্রত করে দিয়েছে। সাহায্য করেছে সময় নির্ঘণ্ট তৈরির।

মানুষ প্রকৃতি বদলের রূপ দেখে ভারি অবাক হয়ে যেত, এখনও হয়। কখনও আকাশের বুকচিরে আলো ফুটে উঠেছে, কখনও ঝুপ করে তা হারিয়ে যাচ্ছে, পাহাড়ের কোলে কিংবা জঙ্গলে অথবা সাগরে কখনও সে আলোর প্রখর তেজ। আবার কখনও ম্রিয়মাণ, শীতল। একই নিয়মে, সময় আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে। কত যুগ যুগান্ত, কত বছর ধরে এমন হয়ে চলেছে, আমরা কেউ জানি না।

কত যুগ যুগান্তর হিসাব হয়তো আমরা রাখতে পারিনি। মানুষ তখন এখনকার মতো হিসাব রাখতে শেখেনি। প্রকৃতির বদল, আবর্তনের সঙ্গে মানুষ লক্ষ্য করেছে-এক সময়ের সঙ্গে আরেক সময়ের নিত্য জীবনের বিস্তর তফাৎ। সে আদিকাল থেকে, গাছের নতুন পাতা গজানোর সময় থেকে অথবা গায়ে জ্বালাধরা গরমের সময় থেকে অথবা প্রকৃতির যে কোনো রূপের সময় থেকে পরবর্তী সময়ে রূপ অথবা গরম কিংবা নতুন পাতার সময় পর্যন্ত হিসাবকে মানুষ প্রাকৃতিক বছর হিসাবে মাপতে শুরু করেছে। তা আজও বিদ্যমান। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তো সে কবে প্রমাণ করে ছেড়েছেন, প্রকৃতির এ রূপ বদলের কারণ পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘুরছে বলেই, শীত-গ্রীষ¥-বর্ষা-বসন্ত ও ঋতুচক্র হচ্ছে। সূর্যকে একপাক খেতে পৃথিবীর যে সময় লাগে তাই বছর। বিজ্ঞানীদের অংক মতে, পৃথিবীর একপাক ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকে-। মানুষের নজর কেড়েছে একভাবেই, রাতের আকাশের, মানুষের কাছে এক পরম বিস্ময় বিশেষ করে চাঁদের চলাফেরা ও আকার-আকৃতি মানুষের নজর কেড়েছে চাঁদের একটু একটু করে ক্ষয় হয়ে যাওয়া আবার একটু একটু করে বেড়ে ওঠা। চাঁদেরও ক্ষয়-বৃদ্ধি, আলো-আঁধারির কারণও তার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা। পৃথিবীর চারিদিকে একপাক ঘুরতে চাঁদের সময় লাগে ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৩ সেকে- অর্থাৎ একমাস।

এখানে একটা কথা বলা দরকার। মাস ও বছরের একটা হিসাব পৃথিবীর প্রদক্ষিণ ও চাঁদের প্রশিক্ষণ থেকে পারয়া যায় ঠিকই; কিন্তু এর ভিত্তিতে অতি সহজেই কোনো বর্ষপঞ্জী বানানো কঠিন ব্যাপার। কারণ, পৃথিবীর প্রদক্ষিণের সময় কিংবা চাঁদের প্রদক্ষিণের সময় বছর কিংবা মাস উভয় ক্ষেত্রেই পূর্ণসংখ্যায় নয়। ফলে জটিলতা অনেক বেশি। চাঁদের হিসাবে যদি মাস গণনা হয় তা হলে বছর হবে ৩৫৪/৩৫৫ দিনে। এ হিসাবে বছর শুরু হলে, কিছু বছর বাদেই ঋতু চক্রের উলটপুরান হবে। যে সময়ে শীত আসার কথা, সে সময়ে এসে যাবে গ্রীষ্ম।

মানুষের সমাজ সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততটাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যেমন বর্ষপঞ্জী রচনার যেখানে সময় আগাম ঘোষণা করা থাকবে। বছরের ভিন্ন ভিন্ন সময়ের জন্য অগ্রিম পরিকল্পনা ও কর্মসূচি মানুষ নিজেদের জন্য করে দিতে পারবে। বর্ষপঞ্জী বা ক্যালেন্ডারহীন জীবন আমরা কল্পনাও করতে পারি না, সভ্যতার মাপকাঠি হিসাবেও এখন বর্ষপঞ্জীকে বিবেচনা করা হয়। সরকারের বাজেট পেশ থেকে, কর আদায় থেকে, পুজো-আর্চনা থেকে, ঈদণ্ডমহরম থেকে, গুডফ্রাইডে বড়দিন থেকে, গরমের ছুটি, পুজোর ছুটি থেকে, পরীক্ষা থেকে নতুন ক্লাসে ওঠা ইত্যাদি সমস্ত কিছুর জন্যই আমরা এখন আগাম সময় ঘোষণার উপর নির্ভরশীল। এমন কী কৃষিকাজ, আবহাওয়া-পানি ঝড়ের আগাম বার্তা পর্যন্ত বর্ষপঞ্জী থেকে আমরা এখন অনায়াসে পেয়ে যাই। তাই বর্ষপঞ্জী এখন শুধু সভ্যতার মাপকাঠি নয়, আমাদের নিত্যসঙ্গী, অপরিহার্য জীবনের অঙ্গ।

সূর্য চন্দ্র গ্রহ নক্ষত্রের চলাচল, গতি, রূপান্তর ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেই বর্ষপঞ্জীর রচনা; রচিত হয়ে আসছে বহু বহু যুগ আগে থেকে। সুমের ক্যালেন্ডার তৈরি হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে। ব্যাবিলোনিয়ার ক্যালেন্ডার তৈরি হয়েছে, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে। ঋগে¦দ থেকে জানা যায়, ভারতের ক্যালেন্ডার রচিত হয়েছে ২৫০০ বছর আগে।

বর্তমানে, পৃথিবীর সব দেশের মানুষই যে বর্ষপঞ্জী মতো কাজ করে চলেছে তা রোমান। আমাদের দেশের ইংরেজরা এ রোমান বা গেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী পদ্ধতি চালু করেছে। আজ সে ধারা অনুসৃত। পাশাপাশি ভারতীয় বর্ষপঞ্জী চলছে। ইতিহাস মতে, শক ক্যালেন্ডারই ভারতে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জী। শুরু করেন বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী বরাহমিহির। সম্ভবত শকাদিত্য বা শালিবাহন রাজা শকাব্দের প্রবর্তক। কেউ কেউ বলেন, ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা কণিঙ্কর সিংহাসন আরোহণের ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘শকাব্দ’ নমে অব্দর প্রচলন করা হয়।

বাংলা বর্ষপঞ্জী রচনা ঠিক কবে চালু করেছে-এ নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। কেউ বলেন, শশাঙ্কর আমল থেকে, কেউ বলেন, আকবরের আমল থেকে। কেউ কেউ আবার মনে করেন, বঙ্গাব্দর সূচনা হয়েছে সম্রাট হোসেন শাহর সময় থেকে। কিন্তু ইতিহাসবিদরা, নানা সন তারিখ ও সময়ের সুক্ষ্ম হিসাব পর্যালোচনা করে শেষ পর্যন্ত রায় দিয়েছেন, বঙ্গাব্দর প্রকৃত প্রচলন হয় সম্রাট আকবরের সময় থেকে। এ সময়েই চাষের কাজ এবং কর আদায়ের ব্যবস্থায় চালু বাংলা বর্ষপঞ্জী চালু হয়। সম্রাট আকবরের রাজকার্যে মন্ত্রী টোডরমল ছিলেন রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে। সে সময়, রাজকাজ এবং ধর্মাচরণ উভয়েই হতো হিজরিবর্ষপঞ্জী মতে। হিজরি চান্দ্র নির্ভর স্বভাবতই, রাজ কাজে বিশেষভাবে কর আদায়ের ক্ষেত্রে বিস্তর অসুবিধা দেখা দিত। প্রতি বছরই, ১৪ দিনের হিসাবের গরমিল থাকায়, কর আদায়ের অগ্রিম ঘোষণায় অসুবিধা হতো। কর তো সে সময় কৃষি খাত থেকেই হতো। যে সময়ে ফসল ওঠার কথা, হিজরি বর্ষপঞ্জীতে তা আগে পরে হয়ে যাচ্ছিল। অব্দ সাধারণত, সময় মাপার উৎস বিন্দু হিসাবে ব্যবহৃত হয়। রাজরাজরার অভিষেক কালকে মনে রেখে, অব্দ চালু ছিল (যেমন শকাব্দ)। আবার নির্বান কালকে স্মরণীয় করে রাখতেও অব্দর প্রচলন আছে (শ্রীলঙ্কায় বুদ্ধাব্দ)। আকবরও তাই সে সময়ে নতুন অব্দ চালু করতে চেয়েছিলেন তারিখ-আকবরের ইলাহি নামে। কিন্তু সে সময়ে বাঙালিরা তা সহজভাবে মেনে নেয়নি। বাঙালিরা সৌরমতে চলতে আগ্রহী থাকায়, চান্দ্র-সৌরব মিশ্রনে নতুন বঙ্গাব্দের সূচনা হলো। তখনকার ৯৬৩ হিজরি সনকে ধরেই (১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) মূলত বাংলা বর্ষপঞ্জীর যাত্রা শুরু। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গাব্দের উৎস আকবরের সময়ের ৯৬৩ হিজরি সনে। অর্থাৎ বঙ্গাব্দের শুরু হলো ৯৬৩ থেকে (এক থেকে নয়)। হিজরি সনের হিসাব চান্দ্র-অনুসারে, বাংলা সন চান্দ্র ও সৌরর মিশ্রনে। তাই ৯৬৩ থেকে বাংলা সন শুরু হলে, বাংলা হিজরি সনের মধ্যে এর মধ্যেই অনেক তফাৎ হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলা সন ১৪২৯ (২০২২ খ্রিষ্টাব্দ), কিন্তু হিজরি সন ১৪৪৩।

আমাদের দেশে সাধারণভাবে দেখা গেছে, আমরা বাঙালিরা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত রাজনৈতিকভাবে পরাধীন ছিলাম। বছরের পর বছর আমরা কোনো না কোনো রাজা-বাদশা, সাহেবদের শাসনাধীন ছিলাম। স্বভাবই রাজা-বাদশা-সাহেবরা তাদের প্রয়োজন নেই, বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বর্ষপঞ্জী চালু করেছেন। কিন্তু রাজকাজে ব্যবহৃত হয়েছে হিজরি ও রোমান আকবরের সময় থেকে চালু ছিল বঙ্গাব্দ, পরে ইংরেজরা তা সরিয়ে আনেন গেগরিয়ান। তারপরেও বঙ্গাব্দর প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। সব বাঙালির ঘরেই সমারোহ আজও বিরাজ করে বঙ্গাব্দর বর্ষপঞ্জী।