ঢাকা সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ঈদ উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য

ড. মতিউর রহমান, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
ঈদ উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য

মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিকভাবে একসঙ্গে বসবাস করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। একত্রে বসবাসের মাধ্যমে মানুষের সামাজিকীকরণ ঘটে থাকে। সামাজিকীকরণের এই প্রক্রিয়ায়, মানুষ বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন উৎসবও তৈরি করেছে যা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় বহন করে। পৃথিবীর সব সমাজ বা সম্প্রদায়ে এ ধরনের উৎসব প্রচলিত রয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষও এ প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। সমাজে একে অপরের সুখ-দুঃখ, আনন্দণ্ডবেদনা ভাগাভাগি করতে মানুষ নানা উৎসবের আয়োজন করে। বিভিন্ন সামাজিক উৎসব এখন বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপনের অংশ। বাঙালির এসব সামাজিক উৎসব এ দেশকে করেছে আরও প্রাণবন্ত, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে ভরপুর।

যখন একটি সামাজিক বা পারিবারিক সমাবেশ উপভোগ করা হয়, তখন এটিকে সাধারণত উৎসব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাই উৎসব মানেই যেকোনো আনন্দের উপলক্ষ্য। তবে বিভিন্ন উৎসবের আনন্দের রং ও রূপ ভিন্ন। একটি উৎসব জনসাধারণের বা বহু মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। উৎস এবং চেতনার ভিত্তিতে উৎসবকে বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন : ধর্মীয় উৎসব, সামাজিক উৎসব, সাংস্কৃতিক উৎসব, পারিবারিক উৎসব, জাতীয় উৎসব ইত্যাদি।

বাঙালি জাতি সবসময়ই উৎসবমুখর। বিভিন্ন সময়ে তারা বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাসে এদেশের মানুষের উৎসবমুখরতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অপূর্ব সমন্বয় রয়েছে। তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে মুসলমানদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা, বৌদ্ধদের বুদ্ধ-পূর্ণিমা এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ধর্মীয় উৎসব এখন অনেক বেশি সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই বলা হয় যে, কেউ যে কোনো ধর্মের হতে পারে; কিন্তু ধর্মীয় উৎসব সবার। মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। তারা বছরে দুইবার ঈদ উদযাপন করে। একটি ঈদুল ফিতর এবং অন্যটি ঈদুল আজহা।

ঈদুল ফিতর মানে ‘রোজা ভাঙার দিন’। দীর্ঘ ১ মাস রোজা রাখার পর মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মীয় দায়িত্ব পালনসহ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে দিনটি পালন করে। হিজরি ক্যালেন্ডার অনুসারে, রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের ১ম তারিখে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। এই দিনে ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা নতুন পোশাক পরেন। তারা ঈদগাহ বা মসজিদে নামাজ পড়তে সমবেত হন। ঈদ উৎসব বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য সবচেয়ে বড় উৎসব।

যেকোনো উৎসব মানুষকে প্রাত্যহিক জীবনের সংকীর্ণ সীমাবদ্ধতা থেকে পুনর্মিলনের বৃহত্তর রাজ্যে নিয়ে যায়। মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদও এর ব্যতিক্রম নয়। ঈদ শব্দের আক্ষরিক অর্থ আনন্দ। আমরা সব সময়ই জানি, সুখ ভাগাভাগি করলে বাড়ে; আর দুঃখ ভাগ করলে কমে যায়।

ঈদের নামাজে ধনী-গরিব, ছোট-বড়, মালিক-শ্রমিক, শিক্ষক-ছাত্র, সাদা-কালো, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একসঙ্গে ঈদগাহ বা মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন। তারা একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। বলা হয়ে থাকে ঈদ উৎসব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে।

আরও বলা হয়, ঈদের দিন একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়াতে তাদের মধ্যে দৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়। এ দিনটি তাই ধনী-গরিব সবাই মিলেই পালন করে থাকি। তারা একে অপরকে সালাম প্রদান ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। প্রতিবেশীর বাড়িতে যান। তাদের খোঁজ-খবর নেন। তারা তাদের নিকটতম এবং প্রিয়জনদেরও খোঁজখবর নেন। তারা একে অপরকে ভালো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করে। গ্রাম ও ছোট শহরে ঈদুল-ফিতরের উৎসব সামাজিকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু রাজধানী বা বড় শহরে নগরবাসীর মধ্যে ভিন্নতার কারণে তা কম সম্প্রীতি সৃষ্টি করে।

মূলত রমজানের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় ঈদ উৎসবের প্রস্তুতি। মুসলমানরা নতুন জামাকাপড়, জুতা, প্রসাধনী, গহনা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাজারে ভিড় করে। এ সময় দোকানগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখা দেয়। দোকান ও শপিংমলগুলো ঈদ উপলক্ষ্যে বিশেষ অফার দিয়ে থাকে। রমজানের শেষ সপ্তাহে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেকেই পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ করতে গ্রামে যায়।

যাত্রাপথে তাদের অনেক বিড়ম্বনা ও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এ সময় যানবাহন দুর্ঘটনায় অনেকের জীবন যায় এবং অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করে। তা সত্ত্বেও তারা তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রাম ও শহরের বাড়িতে ছুটে যান।

ইসলামি প-িতদের মতে, ঈদুল-ফিতর শুধু একটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই নয়, এর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকাও রয়েছে। ঈদুল ফিতর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক বিভাজন দূর ও সাম্য গঠনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃত। ঈদের নির্মল আনন্দে মানুষের মনের সববিদ্বেষ ও শত্রুতা ধুয়েমুছে যায় এবং মানুষের অন্তরাত্মা পরিচ্ছন্ন হয়।

অন্যান্য উৎসবের মতো সামাজিক প্রেক্ষাপটেও ঈদের বিশেষ প্রভাব রয়েছে। এ উৎসব কঠোর ধর্মের উৎসব নয়; এ উৎসব হলো পুনর্মিলন। ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে আপন করে তোলা। বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে; আজকের অস্থির সময়ে সব ভেদাভেদ ভুলে একে অপরকে আলিঙ্গন করার মহৎ তাৎপর্য অস্বীকার করার উপায় নেই।

ঈদুল ফিতর উদযাপন অসমতা ও বৈষম্যের সমাজে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসে। ধনীরা ঈদুল ফিতরের আগে গরিবদের জাকাত, ফিতরা ও সাদকাহ প্রদান করে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষ সেই জাকাত ও ফিতরা পায় যা ঈদের দিনে তাদের কিছুটা আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে পরিবারের সঙ্গে উৎসবের মেজাজে তারা ঈদের দিনটি কাটাতে পারেন। অন্যদিকে, ধনী ব্যক্তিরাও তাদের সম্পদের কিছু অংশ সমাজের দরিদ্রদের প্রদান করতে পেরে আনন্দিত বোধ করেন।

ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য অপরিসীম। মানুষ হিসাবে, আমরা সবাই একটি সমাজে বা একটি রাষ্ট্রে বাস করি। তবে প্রত্যেকেরই আলাদা মতামত বা চিন্তাভাবনা রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, নীতি ও অনুশীলনে পার্থক্য রয়েছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ও আমাদের মধ্যকার সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে এবং একে অপরের থেকে দূরে ঠেলে দেয়-সামাজিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। জীবনের এসব কলুষতা কাটিয়ে কাটিয়ে, সব ভেদাভেদ ভুলে ঈদুল-ফিতর আমাদের একত্রিত করে। আমাদের মধ্যে একতা ও সংহতিবোধ তৈরি করে।

পেশাগত কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছিড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজনরাও ঈদের দিন একত্রিত হয়ে একে অপরের বাড়িতে গিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। তাই ঈদুল ফিতর মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে, শত্রুতাকে পরিণত করে বন্ধুত্বে, আত্মীয়তার বন্ধনকে শক্তিশালী করে এবং সামাজিক সমতাকে উন্নীত করে।

আনন্দ ও বিনোদন মানব জীবনের একটি অপরিহার্য উপাদান। বিনোদনের মাধ্যমে মনোরম পরিবেশে রোমাঞ্চিত হয় মানুষের মন। এভাবে তারা সবসময় মানসিকভাবে সতেজ ও সজীব থাকার সুযোগ পায়। আর মানুষের সুস্থ বিনোদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো ঈদ উৎসব।

ঈদ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় মানুষ দুঃখ ভুলে আনন্দে মেতে ওঠে। উৎসব মানুষের সামাজিক চেতনার আনন্দময় প্রকাশ। উৎসব ছাড়া সমাজের সবাই একত্রিত হতে পারে না। মানুষের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করতে সামাজিক উৎসবের কোনো বিকল্প নেই। এভাবে ঈদ উৎসবের সামাজিক তাৎপর্য গভীর ও ব্যাপক।

সামাজিকভাবে, ঈদুল ফিতর আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনে সর্বস্তরের মানুষকে আলিঙ্গন করার পাশাপাশি দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, নিঃস্ব, এতিম, অবহেলিত এবং সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নদের সঙ্গে উৎসব ভাগ করে নেওয়ার। যার মাধ্যমে সামাজিক সংহতি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রতি বৃদ্ধি পায়। ঈদ উৎসব সামাজিক পুঁজি সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

ঈদ মানে সব ভেদাভেদ ও শত্রুতা ভুলে সব সম্প্রদায়ের মানুষকে আলিঙ্গন করা। সব ধরনের সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে সব মানুষকে অবলম্বন করা। তবে কিছু লোকের গোঁড়ামির কারণে ইসলামের প্রকৃত মর্যাদা ও আদর্শ আজ কলঙ্কিত হয়েছে। আমাদের পরম সত্য উপলব্ধি করতে হবে যে, ধর্ম জগদ্দল পাথরের মতো কোনো স্থির বস্তু নয়।

সেইসঙ্গে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে উৎসবে ধর্মান্ধতা যেন ভ্রাতৃত্বের মহান আদর্শকে গ্রাস করতে না পারে। বরং সাম্প্রদায়িকতার সংকীর্ণ বেড়া বেয়ে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্প্রসারণ ও ঐক্য গড়ে তুলতে পারলেই এই পৃথিবীতে মুক্তির পথ হবে।

ঈদ মানে আনন্দ। এই আনন্দ সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। সবার জীবন হয়ে ওঠে আনন্দময়। এ উৎসবে সবাই অংশগ্রহণ করে। সবার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে রয়েছে সীমাহীন আনন্দ। ঈদ সম্প্রীতির উৎসব।

দুই বছরেরও অধিক সময় ধরে চলা করোনা মহামারির কারণে পরিবার ও সমাজে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, ঈদুল ফিতরের উৎসব তার অনেকটুকুই মেরামত করবে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। সমাজ থেকে যাবতীয় অনাচার দূর করে আমাদের ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার মাধ্যম হিসেবে ঈদ উৎসব একটি সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত