‘দুর্বল মস্তিষ্ক কিছু করিতে পারে না। আমাদিগকে উহা বদলাইয়া সবল মস্তিষ্ক হইতে হইবে। তোমরা সবল হও, গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের সমীপবর্তী হইবে।’ -স্বামী বিবেকানন্দ।
সবলতাই মানুষের জন্মমুহূর্তের অঙ্গীকার। শারীরিক সুস্থতাই মানসিক বলিষ্ঠতার উপায়-উপকরণ। শরীর ও মনের যৌথ কল্যাণপ্রসূ বোঝাপড়ার ওপরই নির্ভর করে তার অনাগত দিনের সুখ-সমৃদ্ধি; নির্ভর করে তার ভবিষ্যৎ ব্যর্থতা সফলতার বিষণœমধুর ইতিহাস। খেলাধুলা তাই শরীর-মন গঠনের এক অন্যতম উৎস। মানব সভ্যতা ক্রমবিবর্তনের এক অপরিহার্য দলিল। দেশে দেশে যুগে যুগে খেলাধুলারও হয়েছে নানা রূপান্তর। হয়েছে গ্রহণ-বর্জনের নব নব পটপরিবর্তন। খেলাধুলা মানুষের অন্ন-প্রাণ-মুক্তবায়ু-স্বাস্থ্য, আনন্দণ্ডউজ্জ্বল-পরমায়ু সাহস-বিস্তৃত বক্ষপট ইত্যাদির চিরন্তন প্রার্থনার এক মহৎ সাধনা ও সিদ্ধি। খেলাধুলার মধ্যেই মানুষ খুঁজে পায় জীবন বিকাশের উন্মুক্ত বিশালতা, পায় জীবনসংগ্রামের দুর্জয় মনোভাব। লাভ করে সাফল্য উচ্ছ্বাস ও পরাজয় গ্লানিকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার দুর্লভ মানসিকতা। মাবন শরীরের জন্য কর্মের পাশাপাশি বিনোদনেরও প্রয়োজন। এ বিনোদনের একটি অন্যতম উপায় খেলাধুলা। খেলাধুলার মাধ্যমে শরীর-মন সতেজ ও প্রফুল্ল থাকে ফলে মানুষ কাজে প্রেরণা পায় যা জাতি গঠনের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। আর তার জন্য আমাদের প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে খেলার মাঠের। শরীর-মন সতেজ ও প্রফুল্ল থাকার ক্ষেত্রে খেলার মাঠের ভূমিকা অপরিহার্য।
আমাদের দেশে খেলার মাঠ খুব বেশি নেই। তবে গ্রাম এবং শহরে যে খেলার মাঠগুলো ছিল তার প্রায় সব মাঠই দখল হয়ে গেছে। মাঠে নগরায়ণ গড়ে উঠেছে। খেলার মাঠ দখল করে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ ও শিল্পকারখানা তৈরি করা হচ্ছে শহরগুলোতে। কৈশোরে একমাত্র বিনোদনের স্থান হলো খেলার মাঠ। আর এ মাঠগুলো দিন দিন প্রভাবশালীদের দখলে যাচ্ছে, হচ্ছে যৌবনের বিনোদনকেন্দ্র। বর্তমান সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণের মধ্যে খেলার মাঠের স্বল্পতা অন্যতম। এর জন্য সমাজব্যবস্থা ও শহরগুলোর অপরিণত পরিকল্পনাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। এ অপরিণত পরিকল্পনায় একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী সুবিধা পেয়ে থাকলেও তা নিকটবর্তী প্রজন্মের জন্য শঙ্কাপূর্ণ। আজ থেকে ১০-১৫ বছর পেছনে তাকালেই একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য ধারণা পাওয়া যাবে। বিগত বছরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে বসতবাড়ি। ফলে পতিত জমিগুলো আর ফাঁকা পড়ে না থাকায় ছেলেমেয়েরা তাদের নিজ নিজ এলাকার স্কুল কিংবা কলেজের মাঠে খেলাধুলা করতে পারছে না। বর্তমানে শহরের স্কুল কিংবা কলেজের মাঠগুলো রক্ষণাবেক্ষণ অথবা নৈশ শিক্ষাব্যবস্থা অধিকাংশ স্কুলে চালু হওয়ার ফলে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আর সেইসঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের বিকেলের সময়গুলো অতিবাহিত করছে। ফলে শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই তারা বিপর্যয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। একসময় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারও ছেলেমেয়েদের একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর মনে হয়। ফলে তারা চায় নতুন বা চমকপ্রদ কোনো অভিনব বিষয়ের মাধ্যমে আনন্দ পেতে। যেমন দল বেঁধে সিগারেট খাওয়া, শিক্ষককে ফাঁকি দিয়ে পাঠশালা পলায়ন, পিকনিক বা সিনেমা দেখা, রাতের অন্ধকারে প্রতিবেশীর বাগানের ফল চুরি করা ইত্যাদি কাজে তাদের আগ্রহ ও নিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। এসব কিছু প্রতিরোধ করার জন্য চাই খেলার মাঠ, যেখানে সময় অতিবাহিত করা যাবে স্বাচ্ছন্দ্যে।
খেলার মাঠ ও অপরাধপ্রবণতা কীভাবে সম্পর্কযুক্ত। খেলার মাঠগুলো ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ার ফলে ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। ফলে তাদের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে স্কুল পালাচ্ছে কিংবা সেখানকার নিয়মশৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে এবং রাষ্ট্রিক আইন বা পৌর বিধিবহির্ভূত কাজ করছে। মাতাণ্ডপিতা বা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েরা পর্নোগ্রাফি বা মাদকে আসক্ত হচ্ছে দিন দিন। কৈশোরে যে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা, খেলাধুলা, গান-বাজনা, অভিনয়, অঙ্কন, কবিতা লেখা এবং অন্যান্য কাজের মাধ্যমে তাদের আত্মপ্রকাশ করার কথা সে সময়ে তারা অপরাধমুখী হয়ে উঠছে। যেমন- চুরি, হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, পকেটমার, মাদক সেবন, যৌনহয়রানি এবং এমন সব লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, যা কি-না অকল্পনীয়। জাতির ভবিষ্যৎ অগ্রগতিনির্ভর করছে কিশোর-কিশোরীদের ওপর, আর এরাই আগামীদিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে, হবে জাতির কর্ণধার। ফলে কিশোর-কিশোরীদের অধ্যয়ন, সৃজনশীলতা, ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা জরুরি। প্রত্যেকটি স্কুলে মাঠ থাকার পাশাপাশি স্কুলের পরিবেশ হওয়া দরকার আনন্দময় ও প্রণোদনাপূর্ণ। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হোক আমাদের নতুন প্রজন্ম, এই হোক সবার প্রত্যাশা।