ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ আগস্ট ২০২৫, ৪ ভাদ্র ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হুমকির মুখে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য

ধন রঞ্জন ত্রিপুরা, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
হুমকির মুখে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য

প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ, প্রাণী ও অণুবীক্ষণিক জীবগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে, সেই বাস্তুতন্ত্রে অগণিত নানা ধরনের জীব প্রজাতির সমাহার বা সমাবেশকে জীববৈচিত্র্য বলে। IUCN I UNEP মতে, ‘কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সব জিন, প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও সমগ্রতাকে জীববৈচিত্র্য বলে’। উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীবাণুর প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে যেমন স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়, তেমনি একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যেও গঠনগত বিভিন্নতা দেখা যায়। জীবমণ্ডলের সমগ্র জীবের মধ্যে এই বিভিন্নতাই হলো জীববৈচিত্র্য। একটি সমাজ বিনির্মাণে যেমন- বিভিন্ন পেশা লোকের দরকার হয়, যারা নিজ নিজ কাজের দ্বারা সমাজকে টিকিয়ে রাখে। ঠিক তেমনি একটি বাস্তুতন্ত্রের সুস্থায়ীভাবে টিকে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজন হয়, যেখানে প্রত্যেক প্রজাতি তাদের নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। জীববৈচিত্র্য বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তোলে।

মানুষ তথা সমগ্র জীবজগতের কাছে জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন কারণে জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রথমত, বেঁচে থাকার জন্য প্রতিটি জীবকে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতাও অতি স্পষ্ট। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ প্রভৃতির জন্য তাকে সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়। জীববৈচিত্র্যের জন্যই মানুষ তার চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয়ত, যেকোনো দেশের জীববৈচিত্র্য সেই দেশের সম্পদ। বিভিন্ন প্রজাতির জীব প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর করে তোলে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ পাহাড়, সমুদ্রসৈকত, বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান প্রভৃতিতে ভ্রমণ করতে যায়। তৃতীয়ত, প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানুষের কর্তব্য প্রতিটি প্রজাতির জীবকে এ পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখা। চতুর্থত, প্রত্যেক জীব বাস্তুতান্ত্রিকভাবে একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বাস্তুতন্ত্রের যেকোনো একটি উদ্ভিদ বা প্রাণীর বিলুপ্ত হওয়া মানে ওই বাস্তুতন্ত্রের অন্যান্য জীবের ধ্বংস ডেকে আনা। একটি জীবের বিনাশ অন্য কোনো জীবের বিপন্নতার কারণ হতে পারে। জীববৈচিত্র্য টিকে আছে বলেই আমরা পৃথিবীর বুকে এখনও বেঁচে আছি। তাই মানুষের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত হলো এই জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখা। পঞ্চমত, পরিবেশ দূষণ রোধ করতে জীবমন্ডলের সার্বিক সংরক্ষণ ও কার্যকারিতা বজায় রাখার কারণে জীববৈচিত্র্য আবশ্যক। পরিবেশে অক্সিজেনের সরবরাহ বজায় রাখতে, বৃষ্টিপাত ঘটাতে উদ্ভিদের ভূমিকা অপরিহার্য।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ভূস্বর্গ নামে খ্যাত পার্বত্য চট্টগ্রামের জীববৈচিত্র্য আজ ভালো নেই। কালের নির্মমগ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বহু প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের অবৈধ উপায়ে গাছপালা ও বন্যপ্রাণী নিধন, বন উজাড়, নির্বিচারে পাহাড়ে আগুন ও পাথর উত্তোলন, অবাধে পাখি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার, নদনদী ও জলাশয় ভরাট পাহাড়ের জীববৈচিত্র্যকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারজনিত দূষণ ও দৈনন্দিন রাসায়নিক ব্যবহারজনিত কারণে আজ নানা প্রাণী বিলুপ্তির পথে। সংরক্ষণের অভাবেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণীকে আমরা হারাতে বসেছি। একটা সময় পার্বত্য এলাকা সুবিস্তৃত অরণ্য ও প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল। ছোট, বড় হরেকরকম বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তর আবাসস্থল ছিল পার্বত্য অঞ্চল। এখন আর আগের মতো সুবিস্তৃত বনাঞ্চল দেখা যায় না। চারদিকে শুধু সেগুনগাছ আর সেগুনগাছ। সময়ের বিবর্তনে আজ পাহাড়ের সেইসব বিস্তৃত অরণ্য ও প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবাসস্থল ও খাদের প্রাচুর্যতা হ্রাস পাচ্ছে। এতে বিলুপ্তির পথে রয়েছে হাজারো বন্যপ্রাণী। যেমন- হাতি, হনুমান, ভল্লুক, মায়া হরিণ, সাম্বার, বানর, গয়াল, বন্য শূকর, বনছাগলসহ নাম না জানা বহু প্রজাতির বন্যপ্রাণী। দিন যত যাচ্ছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য যেন তত হারিয়ে যাচ্ছে।

একটা সময় নানা জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ছিল পার্বত্য এলাকা। কিন্তু বর্তমানে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিতভাবে সেগুনগাছ লাগানো, বন উজাড়, বনজ সম্পদ পাচার এবং নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীদের অভয়াশ্রম। এতে পাহাড়ে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। একইসঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে পাহাড়ের উষ্ণমণ্ডলীয় মিশ্র চিরহরিৎ বনাঞ্চলও। ছোটবেলায় যখন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়াতাম, তখন পাখপাখালির কলকাকলিতে চারপাশের পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠত। এখন কিছু প্রজাতির পাখি যেমন- শালিক, চড়ুই, বুলবুলি ও দোয়েল ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির পাখি খুব একটা দেখা যায় না। হয়তো এসব পাখিগুলোও একসময় হারিয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, বন্যপাখি হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ হলো বন উজাড়, অবাধে পাখি শিকার, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার এবং খাদ্যের অভাব। খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে কিছু প্রজাতির পাখি এর মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর কিছু প্রজাতির পাখি খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো হুমকির মুখে রয়েছে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। কিছু অসৎ মানুষের স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে প্রতিনিয়ত পাহাড়ের পরিবেশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা তেমন ফলপ্রসূ হচ্ছে না। তাই জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি। প্রথমত, দরকার জনসচেতনতা বৃদ্ধি। ‘জীববৈচিত্র্য কি, কেন রক্ষা করা প্রয়োজন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উপায়গুলো কী কী’- এসব বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে হবে। নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে এবং প্রচুর পরিমাণে পরিবেশবান্ধব গাছ লাগাতে হবে। নদীর পানি দূষিত করা যাবে না। পাহাড় কাটা এবং অবাধে পাখি শিকার বন্ধ করতে হবে। শুধু কয়েকটি আলোচিত প্রজাতি রক্ষা করলেই জীববৈচিত্র্য রক্ষা হয় না। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সব ধরনের জীব প্রজাতির ব্যাপারে সমান গুরুত্ব দেওয়া। পরিবেশবিজ্ঞানের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীববৈচিত্র্য প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানব সমাজের উপকারে আসে। যেহেতু আমরা সবাই পরিবেশের অংশ এবং প্রত্যেক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল, তাই প্রকৃতির প্রতিটি জিনিসকে নিজের মনে করে ভালোবাসতে হবে। হারানো প্রকৃতি ও পরিবেশকে পুনরুদ্ধারের জন্য বর্তমান প্রজন্মকে অঙ্গীকার করতে হবে। জীববৈচিত্র্য এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের জন্য টেকসই একটি ভবিষ্যৎ। এর জন্য প্রয়োজন সবার সম্মিলিত ও শক্তিশালী প্রচেষ্টা। তাহলে এমনিতেই রক্ষা পাবে পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য। আর আগামীর বিশ্ব হয়ে উঠবে সুন্দর থেকে আরও সুন্দরতর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত